ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে
চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে শুষ্ক মৌসুম পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নলকূপগুলোতে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না, যা প্রায় এক লাখের বেশি পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে সুন্দরপুর, পাইন্দং, দাঁতমারা, নারায়ণহাট, বখতপুর, ধর্মপুর, ভূজপুর ও কাঞ্চন নগর ইউনিয়নে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে।
বিগত কয়েক বছরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও, এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট পৌরসভার অনেক এলাকায়ও টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, খরা মৌসুম পুরোপুরি শুরু হলে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠতে পারে।
কৃষি ও জীবনযাত্রায় ভয়াবহ প্রভাব
ফটিকছড়ির স্থানীয় কৃষকরা জানান, ধান চাষের জন্য ব্যবহৃত গভীর নলকূপ বা সাবমার্সিবল পাম্পগুলোর কারণে আশপাশের হস্তচালিত নলকূপগুলোতে পানি উঠে না। নারায়ণহাটের বাসিন্দারা বলেন, “আমাদের গ্রামে ধান চাষের জন্য দুটি সাবমার্সিবল পাম্প আছে। মূলত এই পাম্পগুলোর কারণেই গ্রামের সাধারণ নলকূপগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।” ফলে কৃষি উৎপাদন যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি স্থানীয়রা খাওয়ার পানির জন্যও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
দাঁতমারা বাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, “এখানকার ৫০ ভাগ নলকূপে পানি উঠছে না। বাকি নলকূপগুলোতে খুব সামান্য পানি পাওয়া যাচ্ছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেও ভয়াবহ সংকটে পড়েছি আমরা।”
জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি: সুপেয় পানির অভাব
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রায় দুই হাজারের বেশি সরকারি নলকূপ রয়েছে ফটিকছড়িতে। ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত গভীর নলকূপের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। কিন্তু এত সংখ্যক নলকূপ থাকার পরও সংকট কাটছে না।
উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী (জনস্বাস্থ্য) রাশেদুজ্জামান জানান, শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর প্রায় ৫০ ফুটের বেশি নিচে নেমে যায়। ফলে স্বাভাবিক গভীরতায় বসানো নলকূপগুলো থেকে পানি উঠছে না। তাঁর মতে, নলকূপ বসানোর ক্ষেত্রে যদি ৬০-৮০ ফুট গভীরতা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে কিছুটা হলেও এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
পানির সংকটের কারণে স্থানীয়দের মধ্যে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের আশঙ্কাও বাড়ছে। বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে অনেকেই দূরবর্তী কূপ বা নদীর পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি সংকট: দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত পানির ব্যবহার এবং বন উজাড়। অতিরিক্ত টিউবওয়েল ও সাবমার্সিবল পাম্পের ব্যবহারও এই সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
এই সংকট মোকাবিলায় কী করা যেতে পারে?
- নতুন গভীর নলকূপ স্থাপন: ৬০-৮০ ফুট গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে সুপেয় পানি নিশ্চিত করা যেতে পারে।
- বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: বর্ষার পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতি কিছুটা পূরণ করা সম্ভব।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: পানির অপচয় রোধে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।
- পরিকল্পিত কৃষি: পানির স্তর কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ কৃষিকাজে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার। পরিকল্পিত ও টেকসই কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন।
শেষ কথা
ফটিকছড়ির পানি সংকট শুধুমাত্র একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের একটি অংশ। অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, আগামীতে এই সংকট আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের সচেতন হতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। আপনি কি মনে করেন, এই সমস্যা সমাধানে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে? আপনার মতামত জানান কমেন্টে!