31.4 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০২৫
spot_img

ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের আভাস: মারা যেতে পারে ২ লাখ মানুষ

ঢাকার জন্য এক নীরব বিপদ

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে। ভারতীয় প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেটের এই সংযোগের কারণে বাংলাদেশে মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন। যদিও অতীতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল, সাম্প্রতিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ বলছে, এটি কেবল সময়ের ব্যাপার। ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের আভাস

গত কয়েক সপ্তাহে দেশে বেশ কয়েকটি ছোট ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সাধারণ মানুষ একে সাধারণ কম্পন হিসেবে উড়িয়ে দিলেও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ, এই ছোট ছোট ভূকম্পন আসলে ভূগর্ভে শক্তি সঞ্চয়ের ইঙ্গিত হতে পারে, যা একটি বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।

ঢাকা শহর ইতিমধ্যেই অপরিকল্পিত নগরায়ণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য বহুতল ভবন, সরু গলি, অপর্যাপ্ত খোলা স্থান এবং দুর্বল অবকাঠামো—সব মিলিয়ে এটি ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে এক শতাংশ ভবন ধসে পড়লেই তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। আরও ৫ থেকে ৭ লাখ মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়তে পারেন, যাদের উদ্ধার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ও বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা

কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, ভারতীয় প্লেট পূর্ব দিকে ও বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে ধাবিত হচ্ছে। ভূগর্ভে বার্মা প্লেটের নিচে ভারতীয় প্লেট তলিয়ে যাচ্ছে, যাকে বলা হয় ‘সাবডাকশন জোন’। এই ধরণের ভূতাত্ত্বিক গতিবিধি সাধারণত বড় মাত্রার ভূমিকম্পের জন্ম দেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ভূগর্ভে ১ থেকে ১.৫ মিটার সংকোচন হচ্ছে। ভূমিকম্প তখনই ঘটে, যখন এই সংকোচিত শক্তি হঠাৎ মুক্তি পায়। হিসেব অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার জন্য বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা হয়েছে। এটি যখনই মুক্ত হবে, ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ অনিবার্য হয়ে উঠবে। ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের আভাস

এই ধরনের বড় ধরনের ভূমিকম্প সাধারণত এক থেকে দেড় হাজার বছর পরপর হয়ে থাকে। ১৭৬২ সালের ‘গ্রেট আরকান আর্থকোয়েক’ ছিল ৮.৫ মাত্রার, যা চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লা অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। এর পরবর্তী বড় ভূমিকম্প ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত হয়েছিল, যার মাত্রা ছিল ৮.৭। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে আবারও একটি বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ কি বড় ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত?

২০০৮ সালে হাইকোর্ট ভূমিকম্প প্রস্তুতির জন্য একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অধীনে কাজ করছে। তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের প্রস্তুতির চেয়ে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।

সরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার আরবান ভলান্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যাদের লক্ষ্য ৬২ হাজার নির্ধারণ করা হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে, তবে এখনো পর্যাপ্ত লম্বা লেডার নেই, যা দিয়ে বিশতলার ওপরে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো সম্ভব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতির প্রধান ঘাটতিগুলো হলো—সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব, ভবন নির্মাণের সময় ভূমিকম্প সহনশীল ডিজাইন অনুসরণ না করা, এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর প্রশিক্ষণ ও মহড়ার অভাব।

ঢাকায় বড় ভূমিকম্প হলে কী ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেছেন, ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা নগরীর অন্তত দুই লাখ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে মারা যেতে পারেন। পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়বেন, যাদের বেশিরভাগকেই উদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে।

এছাড়া, ভূমিকম্পের ফলে গ্যাস লাইন ফেটে গিয়ে বিশাল অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হতে পারে। রাস্তার বড় অংশ ধসে গেলে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হবে। জল সরবরাহ ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, যা খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট সৃষ্টি করবে। এসব কারণে ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া মানুষও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংকটে মারা যেতে পারেন।

আমাদের কী করা উচিত?

বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, জনগণের মধ্যে ভূমিকম্প মোকাবিলার সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, এবং আবাসিক এলাকায় নিয়মিত মহড়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।

দ্বিতীয়ত, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মানতে হবে। বর্তমানে ঢাকায় যেসব ভবন রয়েছে, তার বেশিরভাগই ভূমিকম্প সহনশীল নয়। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ধার কার্যক্রমকে আরও দক্ষ করতে হবে। গবেষকরা বলছেন, স্মার্টফোনে ‘ন্যাচারাল ডিজাস্টার গেম’ চালু করা হলে জনগণ তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে তা শিখে নিতে পারবে। এটি একটি সহজ ও কার্যকর উপায় হতে পারে।

সর্বশেষ, একটি কার্যকর জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা দরকার, যেখানে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমের পাশাপাশি ভূমিকম্পের আগেই কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, সেটিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরির কাজ আরও শক্তিশালী করতে হবে।

শেষ কথা

ঢাকায় বড় ভূমিকম্প হলে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। তবে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে।

আপনি কী মনে করেন? বাংলাদেশ কি বড় ভূমিকম্পের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত? আপনার মতামত আমাদের জানান কমেন্টে!

2 COMMENTS

  1. ভালো লিখেছেন,সত্যি বলতে প্রাকৃতিক দূর্যোগের জন্য যে কোন দেশ হউক মোকাবেলা টা পরেই করতে হয়,শুধুমাত্র বন্যার ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয় ইহা ছাড়া আমার মনে হয়না আর কোন আগাম প্রস্তুতি প্রয়োজন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ