পানির জন্য হাহাকার, অথচ সমাধান অনিশ্চিত
বাগেরহাট পৌর শহরের মানুষের জন্য সুপেয় পানি যেন সোনার হরিণ হয়ে গেছে। গত ছয় মাস ধরে চরম সংকটে ভুগছে পৌরবাসী। অনেকের বাসায় দিনের পর দিন পানির ফোঁটা পর্যন্ত নেই। আর যাদের ঘরে সামান্য পানি আসছে, সেটাও দুর্গন্ধযুক্ত, ব্যবহারের অনুপযোগী। বাগেরহাটে পানির জন্য হাহাকার
রমজান মাসে এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রোজা রেখে সারাদিন পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে দেখা যাচ্ছে, খাবার রান্নার মতোও পানি নেই! বাধ্য হয়ে কেউ বাজার থেকে বেশি দামে বোতলজাত পানি কিনছেন, কেউবা আশেপাশের পুকুর কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে পানি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে মঙ্গলবার দুপুরে পৌরসভার শতাধিক বাসিন্দা জড়ো হন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে। ক্ষুব্ধ জনগণ পৌর প্রশাসকের কাছে গিয়ে নিজেদের দুর্ভোগের কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে না পেয়ে জেলা প্রশাসকের হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন। এতে তারা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন—দুই দিনের মধ্যে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিলে তারা কঠোর আন্দোলনে নামবেন।
পানি সংকটের মূল কারণ কী?
বাগেরহাট পৌরসভার দাবি, এই সংকটের পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে।
প্রথমত, পৌরসভায় প্রতিদিন কমপক্ষে আট লাখ গ্যালন পানি প্রয়োজন, কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে মাত্র চার লাখ গ্যালনের কিছু বেশি। ফলে বিশালসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন পানির অভাবে ভুগছেন।
দ্বিতীয়ত, শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির মজুত কমে গেছে। ফলে নতুন করে পর্যাপ্ত পানি উত্তোলন করা যাচ্ছে না। বাগেরহাটে পানির জন্য হাহাকার
তৃতীয়ত, বিদ্যুতের লোডশেডিং এই সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ, যখন বিদ্যুৎ থাকে না, তখন নলকূপ থেকে পানি উত্তোলন সম্ভব হয় না।
চতুর্থত, পৌরসভার পুরনো পাইপলাইনগুলো বহু জায়গায় লিক হয়ে গেছে, যার ফলে পানি নষ্ট হচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে ড্রেনের পানির সংস্পর্শে এসে তা দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে যারা অল্প পানি পাচ্ছেন, তারাও সেটা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছেন না।
‘বিল দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু পানি পাচ্ছি না!’
পানি সংকটে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে, কিন্তু পানির দেখা নেই।
শহরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বিল দিই, অথচ ঠিকমতো পানি পাই না। রোজার মাসে কীভাবে চলব? নলকূপের পানি এত দুর্গন্ধ যে, সেটাও ব্যবহার করা যায় না। এখন বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে পানি কিনতে হচ্ছে।’
বাসাবাটি এলাকার জাহিদ হাসান পলাশ বলেন, ‘আজ আমরা একসঙ্গে গিয়ে প্রশাসনকে জানিয়ে এসেছি—দুই দিনের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। যদি না হয়, তাহলে আরও বড় আন্দোলনে যাব। আর চুপচাপ বসে থাকা যাবে না।’
শুধু পানি কিনেই প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা খরচ!
যারা কিনতে পারছেন, তারা পানির জন্য দিনে গড়ে ৩০০-৪০০ টাকা খরচ করছেন। কিন্তু যারা এই বাড়তি খরচ চালানোর সামর্থ্য রাখেন না, তাদের অবস্থা আরও করুণ।
একজন চালক বলেন, ‘আমার বাসায় পাঁচজন সদস্য। দিনে অন্তত ২০০ লিটার পানি লাগে। স্থানীয় দোকান থেকে কিনতে গেলে ৪০০ টাকা লেগে যায়! আমার প্রতিদিনের আয়ই যা, তার অর্ধেক তো শুধু পানিতেই চলে যাচ্ছে।’
অন্যদিকে, অনেক দোকানদার বোতলজাত পানি বেশি দামে বিক্রি করছেন, কারণ চাহিদা বেড়ে গেছে। পানি বিক্রেতাদের একজন জানান, গত কয়েক দিনে বোতলজাত পানির বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
প্রশাসন কী বলছে?
জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসান জানান, ‘বাগেরহাট পৌরবাসীর পানির সমস্যা সম্পর্কে আমরা জানি। তারা আমার কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা এই আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছেন না। তারা বলছেন, এর আগেও বহুবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো কার্যকর সমাধান হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও কি দায়ী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও পানির সংকট দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
- বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।
- অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাধার ভরাটের ফলে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
- সুপেয় পানির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও ভয়াবহ হতে পারে।
কী করা উচিত?
এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
- পাইপলাইন সংস্কার: যেসব জায়গায় পাইপ ফুটো হয়েছে, সেগুলো দ্রুত মেরামত করা দরকার।
- নতুন পানির উৎস তৈরি: নতুন গভীর নলকূপ বসানো এবং পানির বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে।
- বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করলে ভবিষ্যতে সংকট কিছুটা কমতে পারে।
- বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান: বিদ্যুতের লোডশেডিং কমানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে নিয়মিত পানি উত্তোলন করা সম্ভব হয়।
শেষ কথা
বাগেরহাট পৌর শহরের মানুষ দিনের পর দিন সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করছে, অথচ কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো সমাধান দিতে পারছে না। এবার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, দাবি তুলেছেন দ্রুত সমাধানের। দুই দিনের আলটিমেটাম শেষ হওয়ার পর যদি সংকটের সমাধান না হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে।
আপনার এলাকাতেও কি পানির সংকট রয়েছে? আপনি এই সমস্যা নিয়ে কী ভাবছেন? কমেন্টে জানান আপনার মতামত!