26.5 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০২৫
spot_img

রমজানে পানির হাহাকার! চট্টগ্রামে চার দিন ধরে তৃষ্ণার্ত লাখো মানুষ

চার দিন ধরে পানি সংকটে চট্টগ্রামের বিশটি এলাকা

চট্টগ্রামের অন্তত বিশটি এলাকায় গত চার দিন ধরে ভয়াবহ পানিসংকট চলছে। এই সংকটের সূত্রপাত হয় গত শনিবার রাতে, যখন বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের কাজ চলাকালে চট্টগ্রাম ওয়াসার ১১০০ মিলিমিটার ব্যাসের প্রধান সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রমজানে পানির হাহাকার

ওয়াসা সূত্র জানায়, একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খননযন্ত্র ব্যবহার করে কাজ করার সময় পাইপলাইন ফুটো হয়ে যায়। এর ফলে পানি সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আগ্রাবাদ, পশ্চিম মাদারবাড়ী, হালিশহর, বড়পোল, ছোটপোল, ব্যাপারীপাড়া, গোসাইলডাঙ্গা, পানওয়ালাপাড়া, পোস্তারপাড়, ধনিয়ালাপাড়া, কদমতলী, হাজীপাড়া, শান্তিবাগ, মুহুরীপাড়া, পাহাড়তলী, ঈদগাহ ও দেওয়ানহাটসহ আশপাশের এলাকা।

পানির সরবরাহ বন্ধ থাকায় এলাকাগুলোর কয়েক লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। গ্রীষ্মকালীন তীব্র গরম এবং রমজানের সময় হওয়ায় এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।

নগরজীবনে চরম দুর্ভোগ, পানির জন্য দীর্ঘ লাইন

পানি সংকটের ফলে সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় পানির জন্য দীর্ঘ লাইন পড়েছে।

নয়াবাজার এলাকার একটি জলাধার থেকে পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায় বহু নারী ও শিশুকে। সেখানে উপস্থিত এক নারী জানান, তিনি দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না। রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অন্যান্য গৃহস্থালির কাজে পানির অভাবের কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

ঈদগাহ বউবাজার এলাকায় অনেকে উচ্চমূল্যে পানি কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন। একজন গাড়িচালক জানান, তার পরিবারে পাঁচজন সদস্য, আর প্রতিদিন তাদের অন্তত ২০০ লিটার পানি দরকার। এখন প্রতিদিন ৫০০ টাকা খরচ করে পানি কিনতে হচ্ছে, যা তাদের জন্য বাড়তি আর্থিক চাপ তৈরি করেছে।

স্থানীয় মুদিদোকানগুলোতে বোতলজাত পানির চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। একজন দোকানদার বলেন, সাধারণত বোতলজাত পানি বিক্রির পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলেও গত চার দিনে কয়েকশ লিটার পানি বিক্রি করেছেন, যা আগে কখনো হয়নি। রমজানে পানির হাহাকার

বিক্ষোভ ও ওয়াসার বিরুদ্ধে ক্ষোভ

পানি সংকটের সমাধান না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওয়াসার প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিভিন্ন এলাকার মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে ওয়াসার বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন এবং দ্রুত পানি সরবরাহ পুনরায় চালুর দাবি জানান।

বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়, যেখানে উল্লেখ করা হয় যে দীর্ঘদিন ধরে পানির সমস্যা চলছে, কিন্তু সমাধানের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

একজন স্থানীয় বাসিন্দা অভিযোগ করেন, নগরবাসীর পানির প্রয়োজনীয়তা পূরণে ওয়াসা গত এক দশকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও সংকট নিরসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও চট্টগ্রামের পানিসংকট

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামের পানিসংকট শুধু ওয়াসার অব্যবস্থাপনার কারণে হচ্ছে না, বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবেরও অংশ।

নগরায়নের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও জলাধার ভরাটের ফলে স্বাভাবিক জলচক্র ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি খরা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃভরণ কমে গেছে। এর ফলে পানির সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

একজন পানি বিশেষজ্ঞ বলেন, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি না করলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কমে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও সরাসরি প্রভাব ফেলছে।

সমাধানের উপায় কী?

চট্টগ্রামের ক্রমবর্ধমান পানিসংকট মোকাবিলায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

প্রথমত, পানির পাইপলাইন ও অবকাঠামো উন্নত করতে হবে, যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে। পুরনো ও নড়বড়ে পাইপ পরিবর্তন করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে পানির সরবরাহ আরও নিরবচ্ছিন্ন হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, জলাধার সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নিতে হবে। শহরের যেসব খাল ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করা গেলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়ানো সম্ভব হবে।

তৃতীয়ত, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্প চালু করতে হবে। নগর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে সংকটের মাত্রা অনেকটাই কমে আসবে।

চতুর্থত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পানির অপচয় রোধ করা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আরও উন্নত করা সম্ভব।

শেষ কথা

চট্টগ্রামের চলমান পানিসংকট নগর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের প্রতিফলন। যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও ভয়াবহ হতে পারে।

আপনার এলাকা কি পানিসংকটের শিকার? আপনি এই সংকট নিয়ে কী ভাবছেন? আপনার মতামত আমাদের সঙ্গে শেয়ার করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ