যশোরের অন্যতম প্রধান নদ ভৈরব একসময় ছিল স্রোতস্বিনী, জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এবং স্থানীয়দের জীবন-জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু আজ সেই নদ ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়ে এক বিষাক্ত জলাধারে পরিণত হয়েছে। শিল্প, হাসপাতাল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়ির বর্জ্যে দূষিত হয়ে নদীটি এখন দুর্গন্ধযুক্ত এক মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। ২৭৯ কোটি টাকার প্রকল্প
একটি প্রকল্পের আওতায় ২৭৯ কোটি টাকা ব্যয় করে নদীটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই প্রকল্পের কোনো দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া যায়নি। আজও প্রতিদিন অসংখ্য বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে, যার ফলে নদীর পানি ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে এবং জলজ প্রাণীর টিকে থাকার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
দূষণের প্রধান কারণ: কোথা থেকে আসছে বিপর্যয়?
ভৈরব নদ দূষণের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শহরের ড্রেন, হাসপাতাল, শিল্প কারখানা এবং বাজার থেকে আসা বর্জ্য। যশোর শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের সার্জারির তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। বাজার এলাকার আবর্জনাও নদীতে ফেলার কারণে এটি এতটাই নোংরা হয়ে উঠেছে যে এতে প্রাণী বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ নেই। ২৭৯ কোটি টাকার প্রকল্প
নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দূষণের মাত্রা আরও বেড়েছে। উজান থেকে পানি না আসায় জমে থাকা বর্জ্য ও রাসায়নিক দূষণ দীর্ঘদিন নদীতে থেকে যাচ্ছে, যা ক্রমশ পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছে।
নদীর পানির গুণগত মান কতটা বিপজ্জনক?
সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ভৈরব নদীর পানির গুণগত মান ভয়াবহভাবে নিচে নেমে গেছে। নদীর পানিতে ডিজলভ অক্সিজেন (DO) এবং জৈব রাসায়নিক অক্সিজেন (BOD) স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক কম, যা জলজ প্রাণীদের টিকে থাকার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দড়াটানা পয়েন্টে ডিজলভ অক্সিজেন মাত্র ৩.৮১ এবং ঢাকা রোড ব্রিজে ৪.৬৯, যা প্রাণের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত কম। একইভাবে, জৈব রাসায়নিক অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গেছে, যা সরাসরি পানি দূষণকে নির্দেশ করে। এসব উপাত্ত স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ভৈরব নদ প্রায় মরা নদীতে পরিণত হয়েছে এবং এর পানি কোনোভাবেই ব্যবহারযোগ্য নয়।
পরিবেশবিদদের মতামত: কেন ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন?
পরিবেশবিদদের মতে, ভৈরব নদকে বাঁচানোর জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার কারণে দূষণ ক্রমাগত বাড়ছে। বিকল্প কোনো উপায়ে নদীর সঙ্গে সংলগ্ন জলাশয় বা খালের সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হলেও সেটি করা হয়নি। ফলে নদী ধীরে ধীরে মৃত জলাশয়ে পরিণত হচ্ছে।
নদীর দূষণ রোধে প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পৌরসভাকে একত্রে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র সময়োচিত উদ্যোগের মাধ্যমেই দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: কী করা যেতে পারে?
ভৈরব নদকে পুনরুদ্ধার করতে হলে দ্রুত কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। নদীর উৎসগুলো পরিষ্কার করতে হবে এবং শহরের হাসপাতাল, বাজার ও কলকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে। সরকারকে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো প্রতিষ্ঠান নদীতে বর্জ্য ফেলতে পারবে না।
নদীতে উজানের পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে সংলগ্ন খাল ও বিল পুনঃখনন করে সংযোগ স্থাপন করা দরকার। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাড়বে এবং জমে থাকা দূষিত পানি নিষ্কাশিত হবে। এছাড়া, জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে এবং দূষণ প্রতিরোধে নিয়মিত মনিটরিং চালাতে হবে।
সচেতনতা বৃদ্ধি করাও অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় জনগণ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে দূষণের মাত্রা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে। নদীর গুরুত্ব বোঝানোর পাশাপাশি দূষণ রোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
শেষ কথা
ভৈরব নদ শুধু যশোরেরই নয়, বরং বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কিন্তু প্রশাসনের অবহেলা এবং অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে এটি আজ ধ্বংসের পথে। এখনই সময় সচেতন হওয়ার এবং এই নদকে বাঁচানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার।
আপনার মতামত কী? ভৈরব নদ রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন? কমেন্টে জানান এবং পরিবেশ সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে পোস্টটি শেয়ার করুন!