ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে
দেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে কৃষি, গৃহস্থালি কাজ ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই বেশিরভাগ নলকূপ ও পানির পাম্পে পানি উঠছে না, ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে।
কৃষকদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ইরি-বোরো চাষের মৌসুমে পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে গেছে যে অনেক জায়গায় গভীর নলকূপ থেকেও পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির উৎসগুলোও হুমকির মুখে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলার মাঠঘাট পানির অভাবে ফেটে যাচ্ছে।
নদ-নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার ভয়াবহ প্রভাব
দেশের বেশিরভাগ নদ-নদী এখন পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। নিয়মিত খনন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নদীগুলো তাদের স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। বর্ষা শেষে দ্রুত পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে চাষাবাদ ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক সংকট দেখা দিচ্ছে।
বিশেষ করে ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। বর্ষার সময় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলেও শীতের শুরুতেই নদীর বুকজুড়ে বিশাল ধু-ধু বালুচর দেখা যায়। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় জলজ প্রাণী ও দেশি মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও আগের তুলনায় কমে গেছে, ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের আবহাওয়া ব্যবস্থায় চরম পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না, বর্ষাকাল ছোট হয়ে আসছে, আর গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ হচ্ছে। এতে করে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ার ফলে আমাদের দেশেও দীর্ঘমেয়াদি খরা দেখা দিচ্ছে। হিমবাহ গলার ফলে শুরুতে নদীতে পানি বাড়লেও পরবর্তীতে সেই প্রবাহ কমে আসছে। ফলে গ্রীষ্মের শুরুতেই নদী ও জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে।
চলনবিলসহ অন্যান্য জলাশয়ের সংকট
দেশের অন্যতম বৃহৎ জলাভূমি চলনবিল। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন অংশজুড়ে বিস্তৃত এই বিল একসময় সারা বছর পানিতে ভরা থাকত। এখন বর্ষার পরপরই এটি প্রায় শুকিয়ে যায়। ফলে এখানকার দেশি মাছ, জলজ প্রাণী ও পাখি হারিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কয়েক দশক আগেও বর্ষা শেষে চলনবিল সবুজ ফসলে পরিপূর্ণ থাকত। শীতকালে পানির স্তর কমলেও সম্পূর্ণ শুকিয়ে যেত না। কিন্তু এখন বর্ষার শেষেই বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারণও এই সংকটের জন্য দায়ী। জলাশয়ের মাঝখানে বড় বড় পুকুর খনন করে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে।
ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় ও কৃষিতে সংকট
ইরি-বোরো চাষের জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাওয়ায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে আরও গভীর নলকূপ বসাচ্ছেন। অনেক জায়গায় ১০ থেকে ১৫ ফুট গর্ত খুঁড়ে পানি তুলতে হচ্ছে, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই সেটাও শুকিয়ে যাচ্ছে।
গাইবান্ধা, নওগাঁ, দিনাজপুর, পাবনা, নাটোরসহ অনেক এলাকায় কৃষকরা পানির অভাবে ইরি-বোরো চাষ কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা বলছেন, যদি এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমতে থাকে, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে চাষাবাদ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়
নদী, জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক রাখতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, নদীগুলো নিয়মিত খনন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, যাতে বর্ষার পানি ধরে রাখা যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে প্রবাহ বজায় থাকে।
দ্বিতীয়ত, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শহর ও গ্রামে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত।
তৃতীয়ত, কৃষিতে পানির অপচয় বন্ধ করতে হবে। উন্নত সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করলে কম পানিতে চাষাবাদ করা সম্ভব হবে।
চতুর্থত, ব্যাপকভাবে গাছ লাগাতে হবে। বন উজাড় বন্ধ করা গেলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক হবে।
পঞ্চমত, সরকারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে পানি সংকট স্থায়ীভাবে মোকাবিলা করা যায়।
শেষ কথা
পানি সংকটের ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে। কৃষি, পরিবেশ ও জনজীবনে এই সংকটের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আপনার এলাকায় কি পানি সংকট দেখা দিয়েছে? আপনার অভিজ্ঞতা ও মতামত কমেন্টে জানান।
#পানি_সংকট #পরিবেশ #জলবায়ু #নদী #কৃষি