26.5 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০২৫
spot_img

বিপন্ন কুশিয়ারা ও বরাক নদী: অস্তিত্ব রক্ষার কঠিন সংগ্রাম

এখন আমাদের নদ-নদীগুলোর অবস্থা একেবারে সংকটময়। কিছু নদী দখল ও দূষণের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে কুশিয়ারা ও শাখা বরাক নদী অন্যতম। এই দুই নদী পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু এখন তাদের অবস্থান বিপদে। একদিকে, কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে, অন্যদিকে শাখা বরাক নদী হয়ে উঠেছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়।

আজ, যখন আমরা আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালন করছি, তখন এই নদীগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তাদের রক্ষা করার গুরুত্ব আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

কুশিয়ারা নদী: দখল ও দূষণের শিকার

কুশিয়ারা নদী বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত, যা এক সময় উত্কৃষ্ট নদী হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে, এখন তা দখল, দূষণ, এবং অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে বিপন্ন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং রাজনৈতিক চক্রের কিছু সদস্যদের সহযোগিতায় এই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে, যা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। বিশেষত, নদীর উভয় তীরে অবস্থিত প্রতিরক্ষা বাঁধসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

নদী থেকে উত্তোলিত বালু, যার দাম প্রতি ট্রাকে ৬৫০০ থেকে ৮৫০০ টাকা, তা চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এসব কার্যকলাপ নদীকে আরও সংকটময় পরিস্থিতিতে ফেলছে। অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে নদীর বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের দুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে।

প্রশাসন যদিও বিষয়টি নিয়ে নজর দিয়েছে, তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, ফলে পরিবেশবিদরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা না হলে নদীর অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কা রয়েছে।

শাখা বরাক নদী: দখল ও দূষণের কবলে

অন্যদিকে, শাখা বরাক নদীও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন। এক সময় যে বরাক নদীটি ছিল উত্তাল এবং জীববৈচিত্র্যে ভরপুর, তা এখন পুরোপুরি দখল এবং দূষণের কারণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীর চারপাশের জনগণ, বিশেষ করে নবীগঞ্জবাসী, বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করে নদীর দখলদারদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন, কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।

দখল ও দূষণের কারণে বর্ষা মৌসুমে সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়, ফলে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথগুলোর ক্ষতি হয়। পৌর কর্তৃপক্ষ কিছুটা উদ্যোগ নিলেও, এখনো পর্যন্ত নদীটি পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরাক নদীকে মুক্ত করার জন্য এক সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালিত হয়েছিল, কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। এখন শাখা বরাক নদী শহরের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

দূষণ এবং মানবদখল: নদীর উপর চাপ

দূষণ এবং দখল দুইটি বিষয়ই নদীগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুশিয়ারা এবং শাখা বরাক নদীতে অবাধে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে, যা শুধু নদীর পরিবেশকেই নয়, বরং আশপাশের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথগুলো, যেখানে বর্ষায় পানি জমে যায়, সেগুলোও দূষণের শিকার হয়ে পড়ে। জনস্বাস্থ্যের জন্য এটাই এক বড় বিপদ।

নদী রক্ষায় প্রয়োজনে উদ্যোগ

এ পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে সরকারের, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা এবং শাখা বরাক নদী থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার করা উচিত। একইসাথে, নদী এবং তার পরিবেশকে রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও কার্যকর আইন প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।

সমাধান: কি করতে হবে?

কুশিয়ারা ও শাখা বরাক নদী রক্ষা করতে হলে আমাদের নানান দিক থেকে সমাধান খুঁজতে হবে। এসব নদীর দখল, দূষণ এবং অবৈধ কার্যকলাপের ফলে যা ক্ষতি হচ্ছে, তা মেটাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমাধান নিচে তুলে ধরা হল:

১. অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা

কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা সবচেয়ে প্রথম এবং জরুরি পদক্ষেপ। স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিবেশবাদীরা একত্রে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য পর্যাপ্ত নজরদারি এবং আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। স্থানীয় জনগণ এবং পরিবেশবাদীদের সঙ্গে মিলে, অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।

একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা, যেখানে নিয়মিত নদীর তীরে উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে, তা অবৈধ বালু উত্তোলনকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে। একই সাথে, নদী অঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে আরও সচেতন করতে হবে এবং তাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।

২. নদীর দখল মুক্ত করা

শাখা বরাক নদী বর্তমানে দখলদারদের হাতে চলে গেছে এবং এর স্বাভাবিক প্রবাহ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এই নদীটি দখলমুক্ত করার জন্য প্রশাসনকে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় দখলদারদের উচ্ছেদ করে, নদীকে ফের তার প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি।

এই উচ্ছেদ অভিযানটি শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, বরং স্থানীয় জনগণ এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের সহায়তায় পরিচালনা করতে হবে। একই সাথে, প্রশাসনকে দখলদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কেউ নদী দখল করতে সাহস না পায়।

৩. নদী পরিষ্কারকরণ কার্যক্রম শুরু করা

নদী দূষণ রোধে একটি সমন্বিত পরিষ্কারকরণ কার্যক্রম প্রয়োজন। শাখা বরাক নদীতে বর্তমানে শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে, যা পরিবেশ এবং জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

শাখা বরাক নদী এবং কুশিয়ারা নদীর তীরে একটি নিয়মিত ময়লা পরিষ্কারের ব্যবস্থা চালু করা উচিত। প্রশাসন এবং পৌরসভার সম্মিলিত উদ্যোগে, নদীর তীরের ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করা এবং পরবর্তী সময়ে এই ধরনের দূষণ থেকে নদীকে রক্ষা করার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।

এছাড়া, স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করতে হবে যাতে তারা নদীকে ময়লা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার না করে। ময়লা ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি

নদী রক্ষার জন্য শুধু প্রশাসন নয়, সাধারণ মানুষেরও সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। জনসাধারণকে নদীর পরিবেশগত গুরুত্ব ও তার উপকারিতা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। স্কুল-কলেজ এবং মসজিদ-মন্দিরে সচেতনতা সেমিনার আয়োজন, প্রচারণা চালানো এবং মিডিয়ার মাধ্যমে নদী রক্ষার জন্য মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করা দরকার।

এছাড়া, স্থানীয় জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করার জন্য পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। এই ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে, জনগণকে নদী দূষণ এবং দখল রোধে সহযোগিতা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হবে।

৫. স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা

একটি সফল নদী রক্ষার উদ্যোগের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের গুরুত্ব অনেক। স্থানীয় সরকার, পৌরসভা এবং উপজেলা প্রশাসন যদি দায়িত্বশীলভাবে কাজ করে, তবে নদী রক্ষা কার্যক্রম সফল হতে পারে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদী রক্ষায় নিয়মিত মনিটরিং এবং পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

তাছাড়া, প্রশাসনকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে নদীর তীরবর্তী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় সরকার কর্মকর্তাদের নদী রক্ষায় আরও কঠোর এবং দায়িত্বশীল হতে হবে।

৬. নদী পুনর্নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা

নদী রক্ষায় একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদফতর, স্থানীয় প্রশাসন, এবং বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় একটি নদী পুনর্নির্মাণ প্রকল্প শুরু করা যেতে পারে। এই প্রকল্পের আওতায় নদীটির প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, পানি প্রবাহ পুনরুদ্ধার, এবং নদীর বাস্তুসংস্থান রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে।

একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যার মধ্যে থাকবে নদীকে পুনরুদ্ধার করার জন্য পানি উন্নয়ন প্রকল্প, নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, এবং নদী সংলগ্ন জনগণের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ।

৭. আইনের কঠোর প্রয়োগ

নদী রক্ষা এবং দূষণ কমাতে স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন, এবং দূষণের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শক্তিশালী ও কার্যকর আইন প্রয়োগ করতে হবে। কোনো ধরনের অপকর্মকে ছাড় দেওয়া যাবে না, এবং প্রয়োজনে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

শেষ কথা

কুশিয়ারা ও শাখা বরাক নদীর বর্তমান অবস্থা শুধু পরিবেশের জন্য নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যতের জন্যও বিপজ্জনক। নদী রক্ষা করতে না পারলে এর প্রভাব বিভিন্ন দিক থেকে অনুভূত হবে—কৃষি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্য—সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমাদের সকলের দায়িত্ব, নদীগুলোকে রক্ষা করার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া এবং সেগুলোর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখা।

আমাদের পক্ষে এখনই সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রশাসনের কাছে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করা জরুরি। নদীগুলোর পুনরুদ্ধারে যদি আমরা সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নি, তবে এ বিপদ আরও গভীর হতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ