বৈশাখের আগমনী বার্তায় হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন সোনালি ধান কাটায়। কিন্তু সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরের কৃষকদের মুখে এবার হাসি নেই। শ্রমে-ঘামে ফলানো ধানের মাঠ চোখের সামনে নষ্ট হচ্ছে। হাওরের বুক চিরে নির্মাণ করা হচ্ছে সড়ক, যা কিনা স্থানীয় কৃষক, পরিবেশবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি আদৌ কৃষক ও প্রকৃতিবান্ধব কিনা, নাকি এটি শুধুই রাজনৈতিক স্বার্থের খেলাঘর? হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণ
হাওরের সোনালি ফসল বনাম সড়কের লড়াই
হাওরে বোরো ধানের চাষ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার একটি বড় অংশ জুড়ে। সাংহাই হাওরের কৃষকরা গত কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি-বাদলাকে উপেক্ষা করে ধানের চারা রোপণ করেছেন। কিন্তু এখন সেই জমির ওপর দাপট দেখাচ্ছে নির্মাণযন্ত্র। প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণের জন্য কৃষকদের জমি থেকে মাটি কেটে উঁচু করা হচ্ছে রাস্তা। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, সড়ক বানানোর আগে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। এখনো কেউ ক্ষতিপূরণ বা জমি ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে না। এক প্রবীণ কৃষক মর্মান্তিক সুরে বলেন, “জমি শেষ, ধানও শেষ। এভাবে চললে আমাদের ভিটেমাটি থাকবে না।”
ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ। প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ১০ একর ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে শুধু সড়ক ও পাশের খাল তৈরির জন্য। গত বছর কাজ শুরুর পর পানি আসায় থেমে গেলেও এবার পুনরায় ধানের চারা নষ্ট করে মাটি কাটা হচ্ছে। জমি অধিগ্রহণ বা ক্ষতিপূরণের কোনো প্রক্রিয়া শুরু হয়নি বলে অভিযোগ কৃষকদের। অনেকের পরিবারই এই জমির ওপর নির্ভরশীল। তাদের কণ্ঠে হতাশা: “হাওরের জমি আমাদের জীবন। সড়কের নিচে জমি যাচ্ছে, মাটি কেটে আরও জমি নষ্ট। প্রশাসন চোখ বন্ধ করে আছে।”
প্রকল্পের পেছনের শক্তি: কে দায়ী?
এই সড়ক প্রকল্পটি চালু হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ উদ্যোগে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-র অর্থায়নে কাজটি করছে ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে স্থানীয়রা বলছেন, প্রকল্পটির মূল চালিকাশক্তি একজন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী। তাঁর নিজ গ্রামকে সংযুক্ত করতেই হাওরের মাঝখান দিয়ে সড়ক টানা হচ্ছে। হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণ
বিতর্কের মূল কারণ পরিবেশগত ঝুঁকি। হাওরের মাঝখান দিয়ে সড়ক হলে বর্ষায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। উজানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফসল ও বসতির ক্ষতি করবে। এছাড়া, হাওরের মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস হবে। পরিবেশবিদদের মতে, হাওরের প্রাকৃতিক গঠন ভেঙে দেওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়বে। কার্বন শোষণক্ষমতা কমে যাবে, বন্যার তীব্রতা বাড়বে।
প্রশাসনিক উদাসীনতা নাকি ষড়যন্ত্র?
স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা এই সংকটে প্রশ্নের মুখে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের দাবি, এই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বরাদ্দ নেই। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা স্বীকার করেছেন, উচ্চপর্যায়ের একজন নেতার হস্তক্ষেপে কাজ এগোচ্ছে।
গত বছর আওয়ামী লীগ নেতারা কৃষকদের বাধা দমন করলেও এখন অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের অভিযোগ উঠছে। পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, কিশোরগঞ্জের হাওরে সড়ক নির্মাণের সমালোচনার পরও সুনামগঞ্জে একই ভুল পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাদের ভাষ্যে, “হাওরের জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হাওরের ভূমিকা
হাওর শুধু কৃষিজমি নয়, এটি জলবায়ু ভারসাম্য রক্ষারও একটি স্তম্ভ। জলাবদ্ধতা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং কার্বন শোষণে হাওরের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে হাওরের প্রাকৃতিক গঠন ভেঙে দেওয়ায় বন্যার তীব্রতা বাড়বে। পানিপ্রবাহ বাধা পেলে বর্ষায় জলাবদ্ধতা গ্রামগুলিকে ডুবিয়ে দেবে। মাটি কেটে নেওয়ায় জমির পুষ্টিগুণ হারাবে, ফসল উৎপাদন কমবে। নির্মাণযন্ত্র ও যানবাহনের ব্যবহার জলবায়ু সংকটকে ত্বরান্বিত করবে।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, হাওরের প্রকৃতি ও কৃষকের ক্ষতি করে কোনো কাজ সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি ইউএনওর কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন চেয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, জাইকা নিশ্চয়ই প্রকল্পের বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই করেছে। তবে কারও কোনো অভিযোগ পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
অন্যদিকে, পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা জোর দাবি তুলেছেন: “হাওর রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।”
শেষ কথা: হাওর রক্ষায় আমাদের ভূমিকা
সাংহাই হাওরের সড়ক নির্মাণ শুধু স্থানীয় কৃষকের সমস্যা নয়, এটি জলবায়ু সংকট ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি উদাহরণ। সরকারি প্রকল্পের নামে ভৌগোলিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতে এর মাশুল দিতে হবে লক্ষ মানুষকে।
কল টু অ্যাকশন:
এই লেখাটি শেয়ার করে সবাই সচেতন করুন। আপনার মতামত কমেন্টে জানান—হাওর রক্ষায় কী পদক্ষেপ জরুরি? পরিবেশ ও কৃষকদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় সংগঠনগুলিকে সমর্থন করুন।
হাওর শুধু সুনামগঞ্জের নয়, এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। এটিকে বাঁচানোর দায়িত্ব সবার।