27.2 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০২৫
spot_img

সুনামগঞ্জের নদী সংকট: পলি জমে মৃত্যু পথযাত্রী ১০৬ নদী

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুনামগঞ্জ জেলা একটি নদীমাতৃক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তবে, গত কয়েক দশকে সুনামগঞ্জের নদীগুলোতে যে বিপর্যয় ঘটেছে, তা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার জন্য একটি গুরুতর সংকট তৈরি করেছে। ১০৬টি নদী সমৃদ্ধ এই জেলায় বর্তমানে নদীগুলোর অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে, যার ফলে নাব্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে এবং নদীপথের মাধ্যমে যাতায়াতও কঠিন হয়ে পড়ছে। সুনামগঞ্জের নদী সংকট

নদী ভরাটের কারণ ও প্রভাব

সুনামগঞ্জের নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে পাহাড়ি ঢল, বন্যা এবং ভূমিক্ষয়কে দায়ী করা যেতে পারে। প্রতিটি বর্ষায় বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও নদীর পানি প্রবাহের কারণে নদী তীরের মাটি নদীর মধ্যে চলে আসে, যা নদীগুলোর তলদেশে জমে পলি তৈরি করে। এই পলি জমার ফলে নদী গুলো একে একে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

এক সময় যেখানে কার্গো জাহাজ ও বড় বড় নৌকা চলাচল করত, সেখানে এখন কোনো ধরনের নৌকা চলাচল করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এমনকি ছোট ডিঙি নৌকাও নদীর তলদেশে জমে থাকা পলি ও বালির কারণে চলাচল করতে পারছে না। এর ফলে স্থানীয় মানুষের জীবিকা, যেমন মাছ ধরা, নৌকা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা ও পরিবহন ব্যবস্থা, কঠিন হয়ে পড়েছে। নদী বাণিজ্যও দুর্বল হয়ে গেছে, যা সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুনামগঞ্জের নদী সংকট

পরিবেশগত বিপর্যয়

নদী ভরাট হওয়ার ফলে, শুধু মানুষের জীবনযাত্রাই বিপর্যস্ত হয়নি, বরং পরিবেশও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক সময় নদীগুলো ছিল স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নদী পরিবেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণী বাস করত, যা এখন সংকটে পড়েছে। নদী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে গভীর প্রভাব পড়েছে, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। নদী কেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলজ পরিবেশের স্থিতিশীলতা এখন হুমকির মুখে।

এছাড়া, নদী ভরাট হওয়ার ফলে অঞ্চলটির জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপদগুলোও বেড়ে গেছে। নদী বিক্ষিপ্তভাবে প্রবাহিত হলে, বৃষ্টির পানি ও বরফ গলার পানি সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ত, কিন্তু এখন এই নদী সমূহ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বৃষ্টির পানি সহজেই জমে যায় এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে, যা অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি করে।

নদী রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপ

এ পরিস্থিতিতে সুনামগঞ্জের নদী রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জের নদীগুলোর পুনর্খননের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, যাতে নদী একে একে তাদের পুরোনো অবস্থায় ফিরে আসে। নদীগুলোর খনন কাজ শুরু হলে, তাদের প্রবাহ ফিরে পাবে এবং পরিবহন ব্যবস্থাও স্বাভাবিক হতে শুরু করবে।

এছাড়া, নদী কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যও পুনরুজ্জীবিত হবে এবং এটি স্থানীয় অর্থনীতির উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। খনন কাজের মাধ্যমে নদীগুলো যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করবে তা, শুধু প্রকৃতির জন্যই নয়, মানুষ ও পরিবেশের জন্যও অমূল্য হবে।

অন্যান্য সম্ভাব্য সমাধান

এছাড়া, নদী রক্ষায় আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ হতে পারে। সুনামগঞ্জের নদীগুলো রক্ষা করার জন্য আরো একাধিক প্রকল্প হাতে নিতে হবে, যেমন নদী তীরবর্তী এলাকার ভূমিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, এবং সঠিকভাবে নদী ব্যবস্থাপনা চালানো।

এছাড়া, নদী নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য স্থানীয় জনগণের মাঝে শিক্ষা ও উদ্যোগ গ্রহণও জরুরি। শুধু সরকারই নয়, প্রতিটি নাগরিককেও নদী রক্ষায় ভূমিকা পালন করতে হবে। নদী পরিষ্কার রাখার জন্য স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে সচেতনতা সৃষ্টি করা উচিত।

শেষ কথা

সুনামগঞ্জের নদীগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি যে বিপদের দিকে পরিচালিত করছে, তা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। তবে, সরকারের পদক্ষেপ যদি দ্রুত এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে নদীগুলো আবারও প্রাণ ফিরে পাবে এবং তাদের ঐতিহাসিক রূপে ফিরে আসবে। এটি শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলার মানুষের জন্যও একটি আশার আলো হতে পারে।

অতএব, এখন সময় এসেছে আমাদের সকলকে একত্রিত হওয়ার, যাতে আমরা সুনামগঞ্জের নদীগুলোকে রক্ষা করতে পারি এবং এ অঞ্চলের পরিবেশ ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ঘটাতে সাহায্য করতে পারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ