বাংলাদেশ নদীবাহিত দেশ, যেখানে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন ও ভাঙন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে, যা প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষকে গৃহহীন করে তুলছে। ফরিদপুর অঞ্চল নদীভাঙনের জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, যেখানে পদ্মা, মধুমতি ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভয়াবহ ভাঙনে বহু গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা আসার সঙ্গে সঙ্গে এ সংকট আরও ঘনীভূত হবে। নদী গিলে খাচ্ছে বসতভিটা
নদীভাঙনের ভয়াবহ চিত্র
বিগত দুই দশকে ফরিদপুর অঞ্চলে ব্যাপক নদীভাঙনের ফলে প্রায় তিন লাখ মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়েছে। সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা কম দেখানো হলেও, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্যে বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ। নদী গিলে খাচ্ছে বসতভিটা
- ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলায় সর্বাধিক নদীভাঙন ঘটেছে।
- পদ্মার পাড়ে রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরেও হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
- অনেকে এক জায়গায় ১০ বার পর্যন্ত বসতবাড়ি হারিয়েছেন, কিন্তু পুনর্বাসনের কোনো টেকসই উদ্যোগ নেই।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, হাটবাজার ও কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
নদীভাঙনকবলিত মানুষের বাস্তবতা ভয়াবহ। অনেকেই আশ্রয়হীন হয়ে রাস্তার পাশে বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ঠাঁই নিচ্ছেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এসব সমাধান টেকসই নয়।
নদীভাঙনের কারণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা
বাংলাদেশের নদীগুলো বর্ষাকালে তীব্র স্রোতের কারণে গতিপথ পরিবর্তন করে, ফলে নদীর পাড় ধসে পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে।
- অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ নদীর স্রোত বাড়িয়ে দেয়, ফলে ভাঙনের হার বৃদ্ধি পায়।
- অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন ও ড্রেজিং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে, যা ভাঙনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- গাছপালা ও প্রাকৃতিক বাঁধ ধ্বংস হওয়ার ফলে নদীভাঙন আরও ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে ফরিদপুরসহ দেশের অন্যান্য নদীভাঙনকবলিত এলাকায় আরও বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
সরকারি পুনর্বাসন ব্যবস্থা ও বাস্তবতা
সরকার নদীভাঙনের শিকার মানুষদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প হাতে নিলেও, তা বাস্তবায়নে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
- আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু পরিবারকে ঘর দেওয়া হলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
- অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসনের সুবিধা পান না।
- সরকারি তালিকায় অনেক প্রকৃত গৃহহীন মানুষের নাম নেই, ফলে তারা পুনর্বাসনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
- নদীভাঙন প্রতিরোধের জন্য বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও, তা বাস্তবায়নের গতি খুব ধীর।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সহায়তা প্রকল্পগুলোরও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে নদীভাঙনের শিকার মানুষদের সঠিকভাবে সহায়তা করা সম্ভব হচ্ছে না।
নদীভাঙনের স্থায়ী সমাধানে করণীয়
নদীভাঙন প্রতিরোধ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
- নদীর পাড় সংরক্ষণ: নদীভাঙন প্রতিরোধের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা দরকার। বাঁধের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকৌশল ব্যবহারের পাশাপাশি স্থানীয় পরিবেশের ওপর প্রভাব বিবেচনা করতে হবে।
- ড্রেজিং ও নদী ব্যবস্থাপনা: অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধ করে নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- গাছ লাগানো ও সবুজায়ন: নদীর পাড়ে বেশি পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করলে মাটি ধরে রাখা সম্ভব হবে, যা ভাঙন প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
- আবাসন ও কর্মসংস্থান: নদীভাঙনের শিকার মানুষদের জন্য পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারেন।
- জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশকে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।
শেষ কথা
বর্ষার আগে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত নদীভাঙনকবলিত মানুষের জন্য জরুরি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। শুধু ত্রাণ বিতরণ বা অস্থায়ী আশ্রয় নয়, তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়বে, এবং এ সংকট ক্রমশ আরও গভীর হবে।
আপনার মতামত জানান—আপনি কী মনে করেন, নদীভাঙন প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনের জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে? মন্তব্য করুন এবং পোস্টটি শেয়ার করে সবাইকে জানার সুযোগ দিন! 🌍💚