বাংলাদেশের সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত অঞ্চল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে, যা বনভূমি ও স্থানীয় পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কলমতেজি এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবারও গুলিশাখালী বন টহল ফাঁড়ি এলাকায় আগুন দেখা গেছে। এই ধরণের ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের অসতর্কতার ফলেও হতে পারে। তাই এই প্রতিবেদনটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ জনগণকে এই ইস্যুটি সম্পর্কে অবগত করা এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সচেতনতা বাড়ানো। সুন্দরবনে আবারও আগুন
সুন্দরবনে ফের আগুন: সাম্প্রতিক আপডেট
সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কলমতেজি এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও তার ঠিক এক কিলোমিটার দূরে গুলিশাখালী বন টহল ফাঁড়ি এলাকায় নতুন করে আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় সংবাদকর্মীরা রোববার সকাল ৯টার দিকে ড্রোন ব্যবহার করে ওই অঞ্চলে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পান। বন বিভাগও কিছুক্ষণ পর সেখানে আগুনের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। সুন্দরবনে আবারও আগুন
শনিবার সকাল ৯টার দিকে প্রথমে ধানসাগর স্টেশনের কলমতেজি টহল ফাঁড়ির সংলগ্ন এলাকায় আগুন লাগতে দেখা যায়। বন বিভাগ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে গুলিশাখালী এলাকায় নতুন করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে, যা বনভূমির জন্য নতুন হুমকি তৈরি করছে।
আগুন লাগার কারণ ও তদন্ত কার্যক্রম
আগুনের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে চাঁদপাই রেঞ্জের বন সংরক্ষণ দপ্তরের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান এবং বনভূমির ক্ষয় নিরূপণ করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সুন্দরবনের আগুনের কারণ সাধারণত তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথমত, মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বনের আশপাশের মানুষের অসাবধানতা, যা থেকে ছোট্ট একটি স্ফুলিঙ্গ বড় অগ্নিকাণ্ডে রূপ নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, খরার সময় অতিরিক্ত শুষ্ক আবহাওয়া এবং তীব্র গরমে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের আবহাওয়া পরিবর্তিত হচ্ছে, যা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
আগুন নেভানোর প্রচেষ্টা ও চ্যালেঞ্জ
সুন্দরবনের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো কাজ করছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নানা প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে সুন্দরবনের ভেতরে পর্যাপ্ত পানির অভাব এবং দুর্গম পরিবেশের কারণে আগুন নেভানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কলমতেজি এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বনবিভাগ তাদের নিজস্ব সেচ পাম্প ব্যবহার করছে, তবে গুলিশাখালী এলাকার নতুন আগুনের জন্য বাড়তি প্রচেষ্টা দরকার হবে।
বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন বিভাগ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এছাড়াও, যেসব এলাকায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছে, সেখানে দ্রুত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সুন্দরবনে আগুন: পরিসংখ্যান ও পূর্বের ঘটনাগুলো
সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত ২৩ বছরে সুন্দরবনে অন্তত ২৬ বার আগুন লেগেছে, যার বেশিরভাগই ভোলা নদী সংলগ্ন উঁচু বনের এলাকায় ঘটেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের ৪ মে চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া এলাকায় আগুনে প্রায় পাঁচ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২১ সালে শরণখোলা রেঞ্জে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যার ফলে বনভূমির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়ে।
পরিবেশ ও জলবায়ুর উপর প্রভাব
সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের কারণে পরিবেশ ও জলবায়ুর উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আগুনের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, কুমিরসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বসবাসের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বাতাসের মানের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আগুন থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে বিষাক্ত কণা ছড়িয়ে দেয়, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের শ্বাসযন্ত্রজনিত সমস্যার কারণ হতে পারে।
অগ্নিকাণ্ডের ফলে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ। বনভূমির আগুনের ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করে।
সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। এই বন ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতি আরও মারাত্মক হতে পারে।
সমাধান ও করণীয়
সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ড রোধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। বনাঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ড্রোন ও স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে আগুন লাগার সম্ভাবনা চিহ্নিত করা দরকার।
স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের মধ্যে বন সুরক্ষার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। বন এলাকায় ঘুরতে আসা মানুষদের জন্য আরও কঠোর বিধিনিষেধ এবং আগুন ব্যবহারের নিয়ম তৈরি করা যেতে পারে।
আগুন লাগলে দ্রুত তা নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বনবিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং ফায়ার সার্ভিসের সাথে সমন্বয় বাড়ানো গেলে পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।
শেষ কথা
সুন্দরবনের আগুন শুধুমাত্র স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অংশও বটে। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এর প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে।
সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য সবারই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা জরুরি। পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালানো এবং বন সংরক্ষণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আপনার মতামত কী? নিচে কমেন্টে আপনার মত শেয়ার করুন এবং সুন্দরবন সংরক্ষণের উদ্যোগ সম্পর্কে আরও জানতে পরিবেশবিষয়ক অন্যান্য প্রতিবেদন পড়ুন।