বাংলাদেশের বর্তমান জলবায়ু পরিস্থিতি যেন এক গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় এমন একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন যা শুধু পরিবেশবিদদেরই নয়, সাধারণ মানুষকেও ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এক গভীর হুমকি।” রিজওয়ানা হাসানের এই বক্তব্য শুধুমাত্র একটি ভাবনা নয়, এটি একটি সতর্কতা, যে বাংলাদেশ যদি জলবায়ু পরিবর্তনের এ সমস্যা মোকাবেলা করতে না পারে, তবে দেশটির মানচিত্র আসলেই নতুনভাবে আঁকতে হতে পারে। রিজওয়ানা হাসানের ভয়াবহ সতর্কবার্তা
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: বাংলাদেশকে কীভাবে প্রভাবিত করবে?
রিজওয়ানা হাসান বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ানোর কারণে বাংলাদেশ তার সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলো হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। চলতি শতকের মাঝামাঝি সময়েই যদি সমুদ্রপৃষ্ঠ এক মিটার বৃদ্ধি পায়, তাহলে বাংলাদেশকে ২১টি উপকূলীয় জেলা হারানোর ঝুঁকি থাকতে পারে। এটি শুধু বাংলাদেশের মানচিত্রের পরিবর্তন নয়, দেশের গর্বিত ইতিহাস, সংস্কৃতি, জনগণের জীবনযাত্রাও হারানোর শঙ্কা তৈরি করবে। এসব অঞ্চলগুলো ডুবে গেলে সেখানে বসবাসরত কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাদের নিরাপদ আশ্রয় কোথায় হবে? কৃষি ও মাছচাষ, যা দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় অংশ, সেগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে জড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লবণাক্ত পানির ঢুকে পড়া নদী ও অন্যান্য জলাশয়ে মাছের চাষ হবে অসম্ভব। রিজওয়ানা হাসানের ভয়াবহ সতর্কবার্তা
বাংলাদেশে প্রভাবিত জনগণ: জীবিকা সংকটে জনগণের সঙ্কট
বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে মিঠা পানির মাছের উপর। এর মধ্যে বেশিরভাগই উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে এবং এই মাছের জন্য নির্ভরশীল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পানির লবণাক্ততা এতটাই বাড়বে যে, এই জনগণের জন্য মিঠা পানির মাছ সংগ্রহ করা দিন দিন আরো কঠিন হবে। মানুষের জীবিকা হারানো, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা সংকটে পড়া—এগুলোর জন্য কী পরিণতি হতে পারে, তা একেবারে সুস্পষ্ট।
এছাড়াও, কৃষিকাজে অভ্যস্ত জনগণ যারা প্রধানত ধান, ভুট্টা বা অন্যান্য শস্য উৎপাদন করেন, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বন্যা ও খরা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রতি বছর বাংলাদেশ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং খরার কারণে তার জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ ক্ষতি মোকাবেলা করছে। রিজওয়ানা হাসান সতর্ক করেছেন যে, এই ক্ষতি আগামী ২০-৩০ বছর পর দ্বিগুণ হতে পারে, এবং এর ফলে সমাজে বিশাল পরিবর্তন আসবে—যেমন খাদ্য সংকট, পানির অভাব এবং আরও ভয়াবহ সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সামাজিক প্রভাব: বাস্তুচ্যুতি ও সংঘাতের সম্ভাবনা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সংকটও তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলের যদি ডুবে যাওয়া হয়, তবে বাকি দুই-তৃতীয়াংশে জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে, এমনকি দেশের অভ্যন্তরে মানুষের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে, কারণ স্থানান্তরিত জনগণের জন্য বাসস্থানের অভাব এবং খাদ্য ও পানির জন্য সংঘর্ষ বাড়বে। বিশেষত, ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় অঞ্চলে বাস্তুচ্যুত জনগণের জন্য স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ: বাংলাদেশ কেন এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?
বিশ্বের ৮০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী G20 দেশগুলোর কার্যকর পদক্ষেপের অভাবের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে। রিজওয়ানা হাসান এই বিষয়ে সমালোচনা করে বলেন, “বাংলাদেশ, যেটি জলবায়ু ঝুঁকিতে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে। আমরা নিজেরাই এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারছি না, তার উপরে বিশ্বের বড় দেশগুলোর নিষ্ক্রিয়তা আমাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের সমান।”
বিশ্বের তাপমাত্রা যদি ৩ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, তবে সেটা মানবজাতির জন্য সহনশীল মাত্রার অনেক বেশি হবে। এবং এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল দেশগুলোর জন্য অপ্রতিরোধ্য হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে তার উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো পুনর্গঠন, নতুনভাবে মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা এবং কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
শেষ কথা: সময় থাকতে ব্যবস্থা নিন
পরিবেশবিদদের এসব সতর্কবাণী শোনার পর, আমাদের ভাবতে হবে আসলে আমাদের ভবিষ্যত কেমন হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে, আগামীতে বাংলাদেশকে তার মানচিত্র নতুনভাবে আঁকতে হতে পারে—এটি একটি কঠিন বাস্তবতা। পৃথিবী জুড়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য নির্ধারণী মুহূর্ত এই। পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য, শুধু দেশের নয়, বৈশ্বিকভাবে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। সেই উদ্যোগে আমাদের দেশ কীভাবে যোগদান করবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আপনি কি মনে করেন? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত? মন্তব্যে আপনার মতামত জানান।’