28.5 C
Bangladesh
সোমবার, জুন ২৩, ২০২৫
spot_img

আবর্জনার অভিশাপ: কোথায় যাচ্ছে আমাদের নগর ব্যবস্থা?

দুর্গন্ধে নাকাল শহর, বিপন্ন পরিবেশ

আবর্জনায় বিপর্যস্ত পরিবেশ—এটি এখন আর শুধু পত্রিকার শিরোনাম নয়, এটি আমাদের নিত্যদিনের বাস্তবতা। দেশের বিভিন্ন শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অব্যবস্থাপনা, যত্রতত্র ময়লা ফেলার প্রবণতা এবং পরিবেশদূষণের ভয়াবহতা এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, কক্সবাজারসহ দেশের প্রায় সব শহরেই বর্জ্যব্যবস্থার বেহাল দশা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই সংকট শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। আবর্জনার অভিশাপ

নগরজীবনে আবর্জনার চাপে পরিবেশের করুণ অবস্থা

ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা যেন অনিবার্য এক দৈনন্দিন দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। রাস্তার পাশে ময়লার স্তূপ, পচা-গলা বর্জ্যের দুর্গন্ধ, ধুলাবালির দাপট এবং বিভিন্ন সংবেদনশীল এলাকায় বর্জ্য পোড়ানোর কারণে বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বিশেষ করে শীতকালে ঢাকার বাতাস হয়ে পড়ে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। আবর্জনার অভিশাপ

রাজধানীতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বসতি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগেরই বর্জ্য নিষ্কাশনের কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নেই। ফলে দৈনিক বিপুল পরিমাণে গৃহস্থালি বর্জ্য এখানে-সেখানে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবেই বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

ঢাকার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য শহরগুলোতেও একই চিত্র। চট্টগ্রামে প্রতিদিন উৎপন্ন প্রায় ৩ হাজার টন গৃহস্থালি বর্জ্যের পুরোটা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। ফলত, সড়ক, ফুটপাত এমনকি খাল-নদীতেও পড়ে থাকে এই বর্জ্য। খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, বগুড়া, মেহেরপুরসহ অনেক শহরে রাতের মধ্যে ময়লা অপসারণের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে তা দিনের আলো পর্যন্ত পড়ে থাকে রাস্তায়। দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ মানুষ, সঙ্গে বাড়ছে রোগের ঝুঁকি।

হাসপাতাল, কসাইখানা, ছাপাখানা, মিল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যগুলোও যথাযথভাবে অপসারণ না হওয়ায় পরিবেশে ছড়াচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও জীবাণু। বর্ষাকালে এই বর্জ্যগুলো ড্রেন ও নালার মাধ্যমে পানিতে মিশে গিয়ে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তোলে।

পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে আবর্জনার সম্পর্ক

আবর্জনা পোড়ানো, রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা বর্জ্য এবং বর্জ্যের গ্যাস নির্গমন—এসব কার্যকলাপ সরাসরি পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, ময়লা পোড়ানো থেকে যে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, তা শুধু মানুষের জন্যই নয়, বরং বায়ুমণ্ডলেরও ক্ষতি করে। এটি কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন শহরে নিয়মিতভাবে ল্যান্ডফিল বা ভাগাড়ে বর্জ্য পোড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। যদিও সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিচ্ছে, কার্যকর ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।

বায়ু বিশ্লেষণকারী সংস্থা আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার মানুষ বছরে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দিন নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারেন। গত ৯ বছরে ৩১ দিনের বেশি ‘পরিবেশবান্ধব’ দিন ঢাকা নগরবাসী উপভোগ করতে পারেননি।

সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ ও বাস্তব চিত্র

বিভিন্ন পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা বললেও বাস্তবে অধিকাংশ সময় দেখা যায় অনিয়ন্ত্রিত ও সনাতন পদ্ধতিই চলমান। লক্ষ্মীপুর, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ, রাজবাড়ী, কুমিল্লা, ফেনী, শ্রীমঙ্গলসহ অনেক পৌরসভায় ডাস্টবিন, সেকেন্ডারি গারবেজ স্টেশন বা ল্যান্ডফিল নেই। ফলে রাস্তার পাশ, ফসলি জমি, মহাসড়কের ধারে গড়ে উঠছে বর্জ্যের অস্থায়ী ভাগাড়। এতে পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, তেমনি পর্যটনের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—যেমন কক্সবাজারের সৌন্দর্য এখন ময়লার স্তূপে ঢাকা পড়ছে।

সমাধানের পথে: আমাদের করণীয় কী?

সচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবেশের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব বদলাতে হবে। ময়লা যেখানে-সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে।

আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: প্রতিটি শহরে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বর্জ্য সংগ্রহ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। কাঁচা-পচা বর্জ্য আলাদা করে পুনঃব্যবহারযোগ্য প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।

আইন প্রয়োগ: বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অবহেলা করলে জরিমানা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার।

শিক্ষা ও গবেষণা: স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা ও সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা দরকার। বর্জ্যব্যবস্থাপনার উন্নয়নে স্থানীয় গবেষণা বাড়াতে হবে।

জনসচেতন প্রচারণা: গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ ও আবর্জনা সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক প্রচারণা জরুরি। আবর্জনার অভিশাপ

দায়িত্ব আমাদের সবার

পরিবেশ রক্ষা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, আমাদের প্রতিটি নাগরিকের দায়। আমাদের সামান্য অসতর্কতা—যেমন রাস্তায় পলিথিন ফেলা, ডাস্টবিন ব্যবহার না করা—দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। অপরদিকে, আমাদের সচেতনতা, দায়িত্ববোধ এবং সম্মিলিত প্রয়াসই পারে একটি পরিচ্ছন্ন, দূষণমুক্ত, বাসযোগ্য শহর গড়ে তুলতে।

আজই সিদ্ধান্ত নিন—পরিবেশের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য।

🌍 আপনিও অংশ নিন পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের যাত্রায়! এই পোস্টটি শেয়ার করুন, আপনার মতামত জানান কমেন্টে, আর আপনার এলাকার পরিবেশ সমস্যা ও সমাধানের প্রস্তাব আমাদের জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ