বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড উপকূল, যা এক সময় ছিল জাহাজভাঙার একটি বড় শিল্পাঞ্চল, বর্তমানে পরিবেশগত সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২১ সালে এখানে ১৫০টি জাহাজভাঙা কারখানা ছিল, যার মধ্যে ১০৫টি কারখানার পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) উন্নয়নের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে, বাস্তবে মাত্র ৭টি কারখানা “গ্রিন” সনদ পেয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাকি কারখানাগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এখনো নতুন স্থান বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হচ্ছে, যেখানে নতুন জাহাজভাঙা কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে। নতুন অঞ্চল নিয়ে উত্তাল বিতর্ক
এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ওপর চাপ বাড়বে, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বৃদ্ধি পাবে। এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে দাঁড়াবে যদি সীতাকুণ্ডের বোয়ালিয়া মৌজায় নতুন জাহাজভাঙা কারখানা স্থাপন করা হয়।
কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে: এক নজরে সীতাকুণ্ডের অবস্থা
সীতাকুণ্ডের সাতটি মৌজায় ছিল ১৫০টি জাহাজভাঙা কারখানা। কিন্তু নানা কারণে, বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কার্যক্রমের অভাব এবং সরকারি সহযোগিতার অভাবে এই শিল্পে স্থিতিশীলতা আসেনি। এমনকি যে কয়টি কারখানা বন্ধ হয়নি, তারা এখনও পুরনো যন্ত্রপাতি এবং অত্যন্ত সীমিত সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করছে। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, নতুন করে জাহাজভাঙা অঞ্চল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। নতুন অঞ্চল নিয়ে উত্তাল বিতর্ক
নতুন জায়গার জন্য আবেদন: কতটা যুক্তিসঙ্গত?
বর্তমান পরিস্থিতিতে, কিছু ব্যবসায়ী নতুন অঞ্চলের জন্য আবেদন করেছেন, যাতে তারা আরও জাহাজভাঙা কারখানা স্থাপন করতে পারেন। এর মধ্যে অন্যতম আবুল কাশেম, যিনি মাদার স্টিল নামক একটি কারখানার মালিক। ২০১১ সাল থেকেই তিনি এই প্রস্তাব জমা দিয়েছেন, তবে চলতি বছরের আগস্টে আবারো আবেদন পুনরায় জমা দেয়া হয়েছে। যদিও, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিএসবিআরএ (বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেল অ্যাসোসিয়েশন) এবং স্থানীয় বাসিন্দারা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন।
এই অঞ্চলে নতুন ইয়ার্ড স্থাপন হলে পরিবেশের ক্ষতি বাড়বে, তা সীতাকুণ্ডের স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্বেগের সাথে উল্লেখ করছেন। যেমন আকিলপুর এলাকার সৈকতটি যে পর্যটন স্থান হয়ে উঠেছিল, সেটি ঝুঁকির মুখে পড়বে।
জাহাজভাঙার শিল্পে পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ: সমস্যা এবং সমাধান
সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা কারখানাগুলির প্রধান সমস্যা হল পরিবেশদূষণ। সাধারণত, এই শিল্পে ব্যর্থতার মূল কারণ হল নিরাপত্তাহীন কর্মপরিবেশ এবং অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি। ব্যর্থ ব্যবস্থাপনার ফলে সমুদ্রের তলদেশে তেল এবং রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে, যা বন্যপ্রাণী এবং পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়াও, এই শিল্পের ফলে বায়ুদূষণ, পানি দূষণ এবং মাটির ক্ষয় হচ্ছে।
এই সংকট মোকাবিলায়, পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) জাহাজভাঙা উদ্যোগ নেয়া উচিত, যা এই শিল্পের প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে। বিশেষত, যে সব কারখানাগুলো বর্তমানে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের উচিৎ এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যা পরিবেশের ওপর প্রভাব কমায় এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
বিএসবিআরএ’র অবস্থান: নতুন অঞ্চলের বিরোধিতা
জাহাজভাঙা শিল্পের স্বার্থে, বিএসবিআরএ দীর্ঘদিন ধরেই নতুন অঞ্চল বৃদ্ধি না করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের মতে, বিদ্যমান অঞ্চলে সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো পুনরায় সচল করা যেতে পারে। তাদের বক্তব্য, ৫০টি জাহাজভাঙা কারখানাই যথেষ্ট, কেননা বর্তমানে দেশে প্রতি বছর ১৩৬টি পুরানো জাহাজ আসে এবং এক একটি কারখানায় বছরে গড়ে ৩-৪টি জাহাজ ভাঙা হয়। অতএব, নতুন ইয়ার্ডের জন্য কোনো প্রয়োজন নেই।
পরিসংখ্যান এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে সীতাকুণ্ডে ১৩৬টি পুরনো জাহাজ ভাঙার জন্য কার্যত ৫০টি কারখানা যথেষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০টি জাহাজ ভাঙা সম্ভব হচ্ছে ৫০টি কারখানাতেই, এমনকি কয়েকটি গ্রিন ইয়ার্ডে একসঙ্গে একাধিক জাহাজও ভাঙা যায়। সুতরাং, নতুন অঞ্চলের পরিবর্তে পুরনো কারখানাগুলো পুনরায় চালু করা এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে কাজ করানো বেশি কার্যকরী হতে পারে।
এছাড়া, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষায় সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
শেষ কথা: কীভাবে সমস্যার সমাধান হবে?
পরিবেশ এবং স্থানীয় জনগণের স্বার্থের প্রতি সম্মান রেখে, সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান হতে পারে একটি সঠিক এবং সুসংগঠিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, নতুন অঞ্চল বাড়ানোর পরিবর্তে পুরনো কারখানাগুলো পুনরায় চালু করা হোক, এবং শিল্পের প্রভাব কমানোর জন্য কার্যকর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হোক। সীতাকুণ্ডের মত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন, না হলে পরবর্তীতে পরিবেশগত বিপর্যয় হতে পারে যা দেশের জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনবে।
Call-to-Action (CTA)
আপনি কি মনে করেন? সীতাকুণ্ডে নতুন জাহাজভাঙা কারখানা স্থাপন করা উচিত কি না? আপনার মতামত আমাদের সঙ্গে শেয়ার করুন এবং এই সংকটের সমাধান নিয়ে আলোচনা শুরু করুন!
#সীতাকুণ্ড #পরিবেশ #জলবায়ু #শিপব্রেকিং #বাংলাদেশ #পরিবেশবান্ধব #জাহাজভাঙা #গ্রিন_ইয়ার্ড #জলবায়ু_পরিবর্তন #শিল্প_সংরক্ষণ