বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। এই প্রভাব থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণি—শিশুরা। সম্প্রতি খুলনায় আয়োজিত শিশু জলবায়ু সম্মেলনে শিশুদের সরব অংশগ্রহণ এবং তাদের ২১ দফা সুপারিশ শুধু একটি প্রতীকী আহ্বান নয়, বরং এটি একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরে—পরিবেশগত সংকটের মুখে শিশুদের নিরাপত্তা, অধিকার এবং ভবিষ্যৎ এখন কতটা অনিশ্চিত। জলবায়ু সংকটে ২১ দফা দাবি
সম্মেলনের প্রেক্ষাপট
খুলনায় অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী শিশু জলবায়ু সম্মেলনে খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২০০ জন শিশু অংশ নেয়। এই সম্মেলনের আয়োজন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাগ্রত যুব সংঘ (জেজেএস)। সহযোগিতায় ছিল জার্মানির বিএমজেড এবং কিন্ডারনটহিলফে। পাঁচটি পৃথক সেমিনারে আলোচনার ভিত্তিতে শিশুরা নিজেরাই যে ২১ দফা সুপারিশ তুলে ধরে, তা তাদের সচেতনতা ও জলবায়ু নিয়ে উদ্বেগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
শিশুদের ২১ দফা দাবি: সমস্যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
শিশুদের উত্থাপিত দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ সহনশীল বাসস্থান, স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের যাতায়াত নিশ্চিতকরণ, আশ্রয়কেন্দ্রের প্রাপ্যতা এবং নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা। এ ছাড়া তারা জোর দেয় সুন্দরবন রক্ষা, নদী-খাল ও জলাধার সংরক্ষণ, কৃষিকাজের জন্য পর্যাপ্ত সেচব্যবস্থা, দুর্যোগকালে শিশুদের শিক্ষা ও মানসিক সুরক্ষার বিষয়েও। জলবায়ু সংকটে ২১ দফা দাবি
এমনকি জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং দুর্যোগকালে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাপ্যতা—এইসব বিষয়ও দাবির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা শুধু নিজস্ব প্রয়োজন নয়, বৃহত্তর সমাজ ও পরিবেশগত ন্যায্যতা নিয়েও সচেতন।
সমস্যার গভীরে: শিশুরা কেন ঝুঁকিতে?
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিশু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা, পানির সংকট ও আবাসন সমস্যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। অথচ, জাতীয় নীতিনির্ধারণে শিশুদের জন্য জলবায়ুবিষয়ক প্রস্তুতি প্রায় অনুপস্থিত। এই সম্মেলনে শিশুদের দাবির মাধ্যমে সেই ঘাটতির কথাই উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের বার্তা: শিশুদের নিয়ে ভাবা মানেই ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা
সম্মেলনের বিভিন্ন সেশনে উপস্থিত ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিভাগীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা, ইউনিসেফ প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট—শিশুদের উপেক্ষা করে কোনো পরিবেশনীতি বা জলবায়ু পরিকল্পনা কার্যকর হবে না। শিশুদের কণ্ঠস্বর মূলধারার আলোচনায় আনাই এখন সময়ের দাবি।
পরিবেশ মানেই শিশু, শিশু মানেই ভবিষ্যৎ
এই সম্মেলন থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো: পরিবেশকে রক্ষা না করলে শিশুর অধিকার ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ঠেকাতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু অবকাঠামো নয়, চাই মানবিক ও শিশুকেন্দ্রিক পরিকল্পনা।
আমরা কী করতে পারি?
এই সম্মেলন এবং শিশুদের সুপারিশ আমাদের চিন্তা পাল্টানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন এবং নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুরা যাতে শুধু ভুক্তভোগী না হয়, বরং সমাধানের অংশ হতে পারে—সেই সুযোগ দিতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ, অংশগ্রহণ ও কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিতে হবে।
শেষ কথা
“জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পেতে ২১ দফা সুপারিশ শিশুদের”—এই ঘোষণাটি যেন শুধু খবরের শিরোনামে সীমাবদ্ধ না থাকে। শিশুদের কণ্ঠস্বর যেন বাস্তব নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের দায় আছে। তাদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়াটাই সেই দায় পালনের প্রথম শর্ত।
আপনার মতামত দিন
আপনার এলাকার শিশুরা কী ধরনের জলবায়ু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে? আপনি কীভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না। পরিবেশ নিয়ে আরও লেখা পড়তে আমাদের সঙ্গে থাকুন।