26.8 C
Bangladesh
সোমবার, জুন ২৩, ২০২৫
spot_img

বজ্রপাত বাড়ছে কেন? পাঁচ জেলায় ১১ প্রাণহানি

ভয়াবহ বজ্রপাতের এক করুণ চিত্র

দেশের আবহাওয়া এখন যেন আগের চেয়ে আরও বেশি অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। গত রোববার এবং সোমবার বাংলাদেশের পাঁচটি জেলায় বজ্রপাতে অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে একটি পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে, আর আমাদের সামনে আবারও উন্মোচিত হয়েছে প্রকৃতির রুদ্র রূপের বাস্তবতা। এসব মৃত্যু শুধুমাত্র আবহাওয়ার দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি বড় জলবায়ু সংকটের ইঙ্গিতও বটে। পাঁচ জেলায় ১১ প্রাণহানি

কুমিল্লায় ফসলের মাঠ ও খেলাধুলার সময় প্রাণহানি

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ফসলের মাঠে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন নিখিল দেবনাথ (৫৮) ও জুয়েল ভূঁইয়া (৩০)। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাঠে কাজ করার সময় হঠাৎ বজ্রপাত হয় এবং তাঁরা ঘটনাস্থলেই মারা যান। একই দিনে বরুড়া উপজেলার পয়েলগচ্ছ গ্রামে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় বজ্রপাতের শিকার হয়ে প্রাণ হারায় দুজন কিশোর—মোহাম্মদ জিহাদ (১৪) ও মো. ফাহাদ (১৩)। একজন শিশু গুরুতর আহত হয়ে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পাঁচ জেলায় ১১ প্রাণহানি

এসব মৃত্যুর ঘটনা আমাদের জানান দেয়, শুধু কৃষি কাজই নয়, শিশুরাও তাদের খেলাধুলার সময় বজ্রপাতের ঝুঁকিতে আছে। এটা খুবই ভয়ানক ও চিন্তার বিষয়।

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ভয়াবহতা

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন এলাকায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ধান কাটতে গিয়ে ইন্দ্রজিৎ দাস (৩০) এবং স্বাধীন মিয়া (১৫) বজ্রপাতে প্রাণ হারান। একই সময়ে শান্তিগঞ্জ হাওরে ধান শুকাতে গিয়ে নিহত হন ফুলেছা বেগম (৬৫)। হাওরাঞ্চলের খোলা মাঠ, দুর্বল আশ্রয় ব্যবস্থা এবং বৃষ্টির মৌসুমে চাষাবাদের সময় বজ্রপাতের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।

এলাকার মানুষ বজ্রপাতের সময় নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার পরামর্শ পেলেও বাস্তবে কাজের তাগিদে তারা হাওরে থাকতেই বাধ্য হন। এই মানবিক বাস্তবতাও আমাদের ভাবাতে বাধ্য করে।

নেত্রকোনায় শিক্ষক ও ছাত্রের করুণ মৃত্যু

নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায় শিক্ষক দিদারুল ইসলাম (২৮) বজ্রপাতে আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান। একই জেলায় মদন উপজেলার তিয়োশ্রী গ্রামে মাদ্রাসার ছাত্র আরাফাত (১০) বজ্রপাতে মারা যায়। একদিকে শিক্ষার্থী, অন্যদিকে শিক্ষক—দুজনেই বজ্রপাতের বলি হলেন, যা আমাদের শিক্ষা দেয় দুর্যোগের কোনো বয়স বা পেশা ভেদাভেদ নেই।

সুনামগঞ্জে হাওরে কলেজছাত্রের প্রাণহানি

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় কলেজছাত্র রিমন তালুকদার হাওরে গরু চরাতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান। রিমনের মতো তরুণ প্রাণের এভাবে অকালে ঝরে যাওয়া কেবল পরিবার নয়, পুরো সমাজের জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার মৃত্যুর খবরটি যেন একটি বড় সতর্কবার্তা—হাওরাঞ্চলে কাজ করার সময় ঝুঁকি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

চাঁদপুরে বজ্রপাতের শব্দে হৃদরোগে মৃত্যু

চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় বিশাখা রানী (৩৫) বজ্রপাতের বিকট শব্দে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যদিও সরাসরি বজ্রপাতের আঘাতে নয়, কিন্তু বজ্রপাতের ভয়ংকর শব্দ তার প্রাণ কেড়ে নেয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে বজ্রপাতের প্রভাব কেবল আঘাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানসিক ও শারীরিক ধাক্কাও ভয়াবহ হতে পারে।

বজ্রপাত: কেবল প্রকৃতির খেলা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফল

অনেকেই বজ্রপাতকে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতের পরিমাণ ও তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১২% পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি, তাই এখানে বজ্রপাতসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বেড়ে যাচ্ছে।

বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মতো উন্মুক্ত এলাকায় কাজ করা কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। কৃষি নির্ভর গ্রামগুলোতে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র, বজ্রপাত সনাক্তকরণ ব্যবস্থা এবং দ্রুত সতর্কবার্তা ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কী করা উচিত এখন?

একদিকে আমাদের ব্যক্তিগত সচেতনতা বাড়াতে হবে—বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ, উঁচু গাছ বা বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকা জরুরি। অন্যদিকে সরকার ও প্রশাসনেরও উচিত হাওরাঞ্চল ও উন্মুক্ত এলাকায় বেশি করে বজ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন করা, জনসচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ানো এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রিয়েল টাইম সতর্কবার্তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

আবহাওয়া অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন এবং কমিউনিটি লেভেলে একটি সমন্বিত উদ্যোগই পারে বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি কমিয়ে আনতে।

শেষ কথা

পাঁচটি জেলার ১১ জনের মৃত্যু আমাদের জন্য কেবল একটি দুঃখজনক সংবাদ নয়, এটি এক গভীর সতর্কবার্তা। পরিবেশের ক্রমাবনতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব এখন আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়—এটা এখনকার বাস্তবতা। আজকের এ মৃত্যুগুলো হয়তো কোনো সংবাদপত্রের পাতায় বা টিভির স্ক্রলে হারিয়ে যাবে, কিন্তু প্রতিটি প্রাণ হারানোর পেছনে রয়েছে একটি পরিবারের অশেষ বেদনা এবং সমাজের জন্য এক গভীর ক্ষতি।

এখনই সময়, ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, সুরক্ষা নীতিমালা মেনে চলতে হবে। নইলে এই বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, আর প্রতিবারই আমরা হারাবো আমাদের আরও কিছু স্বপ্ন, আরও কিছু সম্ভাবনা।

আপনিও কি ভাবছেন, বজ্রপাত প্রতিরোধে আরও বেশি কিছু করা উচিত? আপনার মতামত আমাদের জানান কমেন্টে! এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পোস্টটি শেয়ার করুন।

#পাঁচজেলায়বজ্রপাতে১১জনেরমৃত্যু #পরিবেশ #জলবায়ু #বাংলাদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ