ঢাকা কি একটু নিশ্বাস ফেলতে পারবে?
ঢাকা শহরের বাতাসে এখন আর জীবনের সুবাস নেই। সকালবেলা শহরে বের হলে যে ধুলার আস্তরণে মুখ ঢাকতে হয়, সেটা শুধু দৃশ্যমান অসুবিধা নয়—বরং গভীর এক স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকায় নিয়মিতই উঠে আসে এই শহরের নাম, যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ঢাকা এখন আর শুধু বাসযোগ্যতার সংকটে ভুগছে না, বরং জীবনঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে। এমন বাস্তবতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এক নতুন উদ্যোগ ঘোষণা করেছে। রাজধানীর অন্তত ৫০টি জনবহুল স্থানে বসানো হবে ‘এয়ার পিউরিফায়ার’ বা বাতাস বিশুদ্ধকারী যন্ত্র। প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানালেন, এসব যন্ত্র বসাতে বেসরকারি খাত থেকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেছে, করপোরেশনের তহবিল থেকে কোনো খরচ হবে না। আশার আলো না ক্ষণস্থায়ী সমাধান
এই ঘোষণা এসেছে গুলশানে ডিএনসিসির নগরভবনে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ পলিসি সংলাপে, যেখানে দূষণমুক্ত ন্যায্য নগর গঠনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। মূলত এটি ছিল এক ধরনের নীতিগত রূপরেখা উন্মোচনের প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ভবিষ্যতের ঢাকা শহরের জন্য একটা নতুন দিশা খোঁজার চেষ্টা হয়েছে।
পুরনো গাড়ি, নতুন রোগ—দূষণের মূল কারণ কী?
যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরে ফিরে আসে, তা হলো—এই শহরের বায়ু এতটা বিষাক্ত হলো কীভাবে? প্রশাসক নিজেই স্বীকার করেছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে বিশ বছরের বেশি পুরনো যানবাহন, যেগুলোর অবস্থা এমনিতেই জরাজীর্ণ। বাসগুলো চলার সময় একে অপরকে ধাক্কা দিতে দিতে চলে, ফলে বাতাসে ছড়ায় কার্বন, ধুলা, কালো ধোঁয়া। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজ, যেগুলো পরিবেশের প্রতি কোনো দায়িত্ব না নিয়েই চলে। আর এসব মিলেই এক ভয়াবহ অবস্থার জন্ম দিয়েছে, যেখানে নগরবাসীর ফুসফুস আর হৃদপিণ্ড সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত।
অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের গবেষণায় উঠে এসেছে আরেকটা ভয়াবহ বাস্তবতা। তিনি বলছেন, ঢাকা এখন জীবনের মান সূচকে প্রায় শেষদিকে, বিশ্বে যানজটের দিক থেকে পঞ্চম, শব্দদূষণে শীর্ষে এবং বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম সারিতে। এই তথ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ আমরা যারা এই শহরে প্রতিদিন চলাফেরা করি, জানি পরিস্থিতি কতটা খারাপ। আশার আলো না ক্ষণস্থায়ী সমাধান
পিউরিফায়ার: তাৎক্ষণিক স্বস্তি, নাকি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান?
এই প্রেক্ষাপটে এয়ার পিউরিফায়ার বসানোর পরিকল্পনা কিছুটা আশার আলো দেখায়। প্রশাসক দাবি করেছেন, প্রতিটি পিউরিফায়ার একশোটি গাছের সমান বাতাস বিশুদ্ধ করতে পারবে। এক অর্থে এটা নিঃসন্দেহে তাৎক্ষণিক স্বস্তি দিতে পারে। বিশেষ করে জনবহুল এলাকা, ট্রাফিক সিগন্যাল বা হাসপাতালের মতো স্থানে এসব যন্ত্র বসানো হলে কিছুটা নির্মল নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
তবে বাস্তবতা হলো, পঞ্চাশটি যন্ত্রে পুরো ঢাকার বাতাস বিশুদ্ধ করা সম্ভব নয়। এটি হবে কিছুটা জায়গা-নির্দিষ্ট, সময়-সীমিত কার্যক্রম। আর এই যন্ত্রগুলো রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টাও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিন ধুলায় ছেয়ে যাওয়া, যান্ত্রিক ত্রুটি, কিংবা বিদ্যুৎ সংযোগের অভাব—সবই এর কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। আর আমাদের দেশের বাস্তবতা বলছে, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনায় বরাবরই ঘাটতি রয়ে গেছে।
টেকসই সমাধানের পথে নবায়নযোগ্য জ্বালানি
তবে আশাব্যঞ্জক খবর হচ্ছে, ডিএনসিসি এই পিউরিফায়ার স্থাপনকে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা হিসেবেও দেখছে। প্রশাসক জানালেন, ভবিষ্যতে ঢাকার বাসাবাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যেখানে গৃহকরের ওপর পাঁচ শতাংশ কর রেয়াত দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এছাড়া ঢাকার কিছু পরিকল্পিত এলাকায় ভবনের উচ্চতা কাছাকাছি হওয়ায় সোলার প্যানেল স্থাপন করে নিজেদের বিদ্যুৎচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সুযোগও তৈরি হচ্ছে।
এই পদক্ষেপগুলো যদি বাস্তবায়ন হয়, তবে তা কেবল বায়ুদূষণ রোধ নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের এই প্রচেষ্টাগুলো শহরের একটি নতুন পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে, যা হবে অনেক বেশি টেকসই।
পরিবর্তনের জন্য শুধু প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন মনোভাবের রূপান্তর
সংলাপে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত ছিলেন যে শুধু প্রযুক্তি দিয়েই শহরকে দূষণমুক্ত করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন জনসচেতনতা, সামাজিক আচরণে পরিবর্তন, এবং নিয়মনীতি মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বললেন, “আমাদের নিজেদের চাহিদা কমাতে হবে, এবং দূষণকারী যারা আছেন, তাদেরই সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে।” অধ্যাপক ইজাজ হোসেনের মতে, যানজট নিরসনে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার এবং চার্জিং স্টেশনে সৌরশক্তির ব্যবস্থাপনা গড়ে তুললে বড় রকমের পার্থক্য আনা সম্ভব।
রৌফা খানম আরও বাস্তবভিত্তিক কথা বলেন। তিনি মনে করিয়ে দেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে আইন থাকলেও বাস্তবায়ন দুর্বল। কারিগরি দক্ষতা, শক্তিশালী মনিটরিং সিস্টেম এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ছাড়া এই আইনগুলো বাস্তব রূপ নেবে না।
নাগরিক সমাজ ও তরুণদের ভূমিকা কোথায়?
সুশীল সমাজ এবং নাগরিক সংগঠনগুলোরও এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা আছে। গাউস পিয়ারী বলেন, পরিবহন, কৃষি, অফিস-আদালত কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। শুধু সরকার কিছু করবে—এই ভরসা করলে হবে না। পরিবর্তন শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকেই।
ঢাকার তরুণরা, যারা প্রতিদিন স্কুল-কলেজে যায়, অফিস করে, জীবন গড়ে—তাদের মধ্যে এই সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া গেলে শহর একদিন বদলাবে। পরিবেশ নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই দিক থেকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
নতুন আশার পথ, পুরনো বাস্তবতা
‘ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ৫০টি জায়গায় বসানো হচ্ছে এয়ার পিউরিফায়ার’—এই খবরটা শুধু একটি প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নয়, বরং ঢাকাবাসীর জন্য একটি প্রতীকী বার্তা। সরকার, করপোরেশন, বেসরকারি খাত ও নাগরিক—সবাই মিলে যদি ছোট ছোট উদ্যোগকে বড় স্বপ্নে পরিণত করতে পারি, তাহলে হয়তো একদিন সত্যিই এই শহরের আকাশটা আবার নীল হবে।
তবে সেই দিনের জন্য শুধু যন্ত্র বসালেই চলবে না। আমাদের রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলা আনতে হবে, গাড়ির বয়স নির্ধারণে কঠোরতা আনতে হবে, নির্মাণ প্রকল্পগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে। এবং সবচেয়ে জরুরি—আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। কারণ, আমরা যদি আমাদের শহরের প্রতি দায়িত্বশীল না হই, তাহলে কোনো যন্ত্রই আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।
শেষ কথাঃ আমাদের নিঃশ্বাস এখন আমাদেরই দায়িত্ব
একটা সময় ছিল, যখন ঢাকার আকাশে পাখির ডাক শোনা যেত। এখন সেই আকাশ ধুলায় ঢাকা, আর পাখির ডাক চাপা পড়ে হর্ণের আওয়াজে। কিন্তু সব হারিয়ে যায়নি। যদি আমরা চাই, যদি আমরা উদ্যোগ নিই, তবে এই শহর আবার ফিরে পেতে পারে তার হারানো প্রাণ।
আপনার কী মতামত? আপনি কি বিশ্বাস করেন, এই পিউরিফায়ার বসানো ঢাকার বাতাসকে একটু নির্মল করতে পারবে? নিচে মন্তব্য করে জানিয়ে দিন, এবং শেয়ার করুন এই লেখাটি। আসুন, আমরা সবাই মিলে কাজ করি একটা পরিচ্ছন্ন, সুস্থ, ও সবুজ ঢাকার জন্য।