৩০ এপ্রিল, আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শব্দদূষণ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। প্রতিবছর এই দিনটি পালন করা হয়, যাতে শব্দদূষণ কমানোর উদ্যোগে আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন ক্যাম্পেইন, র্যালি, সেমিনার এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম করা হয়। তবে প্রশ্ন উঠছে, আমরা কতটা সচেতন হচ্ছি? বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণহীন শব্দদূষণ
বাংলাদেশে শব্দদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বাজানো, অযথা গাড়ির হর্ন, নির্মাণস্থল বা শিল্পকারখানার শব্দ—এই সব কিছুই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর প্রভাব কি আমরা যথাযথভাবে অনুভব করছি?
শব্দদূষণ—একটি ভয়াবহ বাস্তবতা
বাংলাদেশের শহরগুলোতে শব্দদূষণ একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, যেখানে গড় শব্দমাত্রা ১১৯ ডেসিবেল। এটি অনেকটাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকার পরেই রয়েছে রাজশাহী, যেখানে গড় শব্দমাত্রা ১০৩ ডেসিবেল। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছে, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবেল এবং বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবেল শব্দের সীমা থাকা উচিত। অথচ বাংলাদেশে শব্দের এই সীমা অনেকাংশে অতিক্রম করছে। বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণহীন শব্দদূষণ
শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব
শব্দদূষণের শারীরিক এবং মানসিক প্রভাব তীব্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ বিশ্বব্যাপী শব্দদূষণজনিত সমস্যায় ভুগছেন। ৬৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, এবং ৯০ ডেসিবেলের শব্দ শ্রবণশক্তি হ্রাস, আলসার এবং স্নায়বিক সমস্যার কারণ হতে পারে। ১২০ ডেসিবেল এর শব্দ কানে ব্যথা সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘস্থায়ী উচ্চমাত্রার শব্দ স্ট্রেস, উদ্বেগ, ঘুমের ব্যাঘাত, উচ্চ রক্তচাপ, এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
শব্দদূষণের ক্ষতি শুধুমাত্র মানুষের জন্যই নয়, এটি প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণীর উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বন্যপ্রাণীরা তাদের টিকে থাকার জন্য শব্দের উপর নির্ভর করে। অতিরিক্ত শব্দ তাদের প্রজনন প্রক্রিয়া এবং চলাফেরায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে আইন ও নীতিমালা
বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৬ সালে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালার অধীনে পাঁচটি ভিন্ন জোন নির্ধারণ করা হয়েছে—নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক এবং শিল্প এলাকা। প্রত্যেকটি অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট শব্দমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাস্তবে এসব বিধিমালা কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সরকারের কাছে বিধিমালার প্রয়োগ দুর্বল এবং প্রচারের অভাব রয়েছে, যা শব্দদূষণের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়।
সচেতনতা ও আইন প্রয়োগের গুরুত্ব
বাংলাদেশে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। যদিও শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালার অধীনে শাস্তির বিধান রয়েছে, তবে এটি সাধারণত কার্যকর হয়নি। ২০২৫ সালের নববর্ষ উদযাপনকালে ৯৯৯ জরুরি সেবায় এক হাজারেরও বেশি শব্দদূষণ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়লেও, তার মধ্যে মাত্র কিছু অভিযোগের উপর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই দুর্বল প্রয়োগের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে শব্দদূষণের বিরূপ প্রভাব আরও গভীর হয়েছে।
সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম, শিক্ষা কার্যক্রম এবং বড় পরিসরে প্রচারণার ব্যবস্থা জরুরি। যদি জনগণ শব্দদূষণের ঝুঁকি এবং আইনি সীমা সম্পর্কে অবগত হন, তাহলে তারা আইনের প্রয়োগে সহায়তা করতে উৎসাহী হবে।
প্রযুক্তির ব্যবহার ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
শব্দদূষণ কমানোর জন্য প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে শব্দ প্রতিরোধী দেয়াল, কম শব্দের যানবাহন এবং হাসপাতাল-স্কুল এলাকায় নিরব জোন তৈরি করা উচিত। এই উদ্যোগগুলো শহর পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও হর্ন এবং বাসাবাড়ির উচ্চ শব্দ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিত।
দেশের উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শব্দদূষণ প্রতিরোধ
শব্দদূষণ রোধে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং সাধারণ মানুষ মিলেই এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং উন্নত পরিকল্পনা নিয়ে আমরা একটি শান্ত, সুস্থ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।
শেষ কথা
শব্দদূষণ এখন বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং জীবনের গুণমানের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান সম্ভব, যদি আমরা সবাই সচেতন হই এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করি। আপনিও যদি শব্দদূষণের বিরুদ্ধে সচেতন হতে চান, তাহলে আজ থেকেই উদ্যোগী হন এবং সঠিক নিয়মাবলী মেনে চলুন।