বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা, সাদা পাথর এলাকায় সম্প্রতি এক নতুন সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সিলেটের এই জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, যা দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত, এখন ‘পাথরখেকো‘দের কবলে। গত ২৩ এপ্রিল থেকে এই এলাকায় শুরু হয়েছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন। এর আগে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি এবং শাহ আরেফিন টিলা এলাকায় ব্যাপক পাথর লুট হয়েছিল, তবে এবার সাদা পাথরের দিকে নজর পড়েছে এসব অবৈধ চক্রের। প্রশাসন কি যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে?
এটি শুধু পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, পরিবেশ এবং জলবায়ু সংকটেও নতুন এক অধ্যায় যোগ করছে।
সাদা পাথর: সৌন্দর্য এবং বিপদ
সাদা পাথর, যেটি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি সুপরিচিত পর্যটন স্থান, সেখানে অবস্থিত ছোট-বড় অসংখ্য পাথর যা একাধিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তৈরি করে। তবে এই অঞ্চলের পাথর গুলোর বৈধ উত্তোলন ও ব্যবহারের নিয়ম-নীতির অনুপস্থিতি, এবং অবৈধ উত্তোলন চলমান থাকায়, বর্তমানে এর সৌন্দর্য বিপদে পড়েছে।
এলাকার মূল আকর্ষণ হলো ধলাই নদী দিয়ে প্রবাহিত জল, যা সাদা পাথরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আজকাল, এই অঞ্চলে পাথর উত্তোলনকারীরা বেলচা, কোদাল, শাবল এবং বিভিন্ন ভারী যন্ত্র ব্যবহার করে পাথর উত্তোলন করছে। দিন-রাত চলছে এই অবৈধ কার্যক্রম, যার ফলে পরিবেশে গভীর প্রভাব পড়ছে।
অবৈধ পাথর উত্তোলনের চিত্র: ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ
সাদা পাথরের অঞ্চল, যা এক সময় সৌন্দর্য ও শান্তির প্রতীক ছিল, এখন তার নিরাপত্তাহীনতায় ডুবতে চলেছে। ২৩ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই অবৈধ পাথর উত্তোলনের কার্যক্রমে শ্রমিকেরা প্রতিদিন সাদা পাথরের উপরিভাগ থেকে পাথর তুলে, এসব পাথর নৌকায় বোঝাই করে ধলাই নদী দিয়ে অন্য এলাকায় নিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকরা জানান, পাথর উত্তোলনের জন্য যে নৌকাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলি প্রতিদিন শত শত পাথর বহন করে। প্রশাসন কি যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে?
প্রথম দিকে পাথর উত্তোলনটি আড়ালে-আবডালে চললেও, এখন এটি প্রকাশ্যেই ঘটছে। সাদা পাথর এলাকার দুটি ভিন্ন জায়গায় এই পাথর উত্তোলনের কাজ চলছে। বৃষ্টির দিনেও কাজ থেমে থাকে না। অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথরগুলি পরে বিক্রি করা হয়, যা স্থানীয় বাজারে পাথর ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যায়।
এই অনিয়মিত পাথর উত্তোলন শুধু ঐতিহ্যগত পরিবেশের জন্য বিপদজনক নয়, বরং বৃষ্টির পানি প্রবাহ, ভূগর্ভস্থ জলস্তর এবং নদীর স্রোতের ক্ষতিও ঘটাচ্ছে।
প্রশাসনিক অভিযান: সাফল্য না ব্যর্থতা?
প্রশাসন এই অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফলাফল তেমন আশাব্যঞ্জক হয়নি। পাথর উত্তোলনকারীরা অবৈধভাবে কাজ করলেও, প্রশাসনের অভিযান কিছুদিন পরেই থেমে যায়। ২৬ এপ্রিল, ২৭ এপ্রিল, এবং ২৮ এপ্রিল প্রশাসন অভিযান চালালেও, এটি তেমন কার্যকর হয়নি। অভিযানের পরেও শ্রমিকরা আবার পাথর উত্তোলন শুরু করে, যেটি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ যেমন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, অভিযানে দোষীদের কারাদণ্ড দেওয়া, তাও এই অবৈধ চক্রের কার্যক্রম থামাতে পারছে না। যেহেতু স্থানীয় জনগণ এবং শ্রমিকরা জানেন যে প্রশাসন কিছুদিন পর আবার শিথিল হয়ে যাবে, তারা নিজেদের কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়ে যায়।
বিপন্ন পরিবেশ এবং জলবায়ু সংকট
পাথর উত্তোলনের এই অবৈধ কার্যক্রম সিলেট অঞ্চলের পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর বিপদজনক প্রভাব ফেলছে। পাথর উত্তোলন থেকে তৈরি হওয়া গভীর গর্তগুলো বৃষ্টির পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, যা স্থানীয় নদীর স্রোত ও পানি প্রবাহে পরিবর্তন আনে। অবৈধ উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, যা পরিবেশের ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করছে।
এছাড়া, পাথর উত্তোলনকারীরা এই এলাকা থেকে সাদা পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে যে মাটি খুঁড়ে ফেলছে, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি মাটি শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যা পরবর্তীতে ভূমি ক্ষয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা বাড়াতে পারে।
সরকারের পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সরকার ইতিমধ্যেই দেশের ৫১টি পাথর কোয়ারির মধ্যে ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সাদা পাথর এলাকায় অবৈধ উত্তোলন বন্ধ করতে সরকারের পদক্ষেপের আরও কঠোরতা প্রয়োজন। প্রশাসন এবং পরিবেশ রক্ষাকারী সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণই একমাত্র সমাধান, যাতে সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হয়।
উপসংহার: আমাদের দায়িত্ব
যতই প্রশাসন অভিযান চালাক, ততই পাথরখেকোরা আরও তৎপর হয়ে উঠছে। এই চক্রকে বন্ধ করতে আমাদের সবার অংশগ্রহণ জরুরি। সিলেটের সাদা পাথর এবং অন্যান্য পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধ উত্তোলন যদি বন্ধ না করা যায়, তবে এর পরিণতি হতে পারে অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের প্রকৃতি এবং জলবায়ু রক্ষায় আরও কঠোর পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা প্রয়োজন। প্রশাসন ও জনগণ একযোগে কাজ করলে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে সক্ষম হবো।
আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না
এ বিষয়ে আপনি কী ভাবছেন? আপনার মতামত এবং পরামর্শ শেয়ার করুন, যাতে আমরা একসাথে এ সমস্যার সমাধান করতে পারি।