25.5 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, মে ২৭, ২০২৫
spot_img

৩১৭ কোটির প্রকল্প কি পারবে শুভাঢ্যা খাল প্লাস্টিকের রাজত্ব ঘোচাতে?

একসময় প্রমত্তা নদী বা খাল ছিল সভ্যতার জীবনরেখা। ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অসংখ্য খাল ও নদী তেমনই ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে, দখল আর দূষণের শিকার হয়ে অনেক জলপথ আজ মৃতপ্রায়। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বুক চিরে বয়ে চলা সাত কিলোমিটার দীর্ঘ শুভাঢ্যা খাল তেমনই এক করুণ পরিণতির শিকার। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর সাথে সংযোগ স্থাপনকারী এই খালটি একসময় ছিল স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। নৌকা চলত, জেলেরা মাছ ধরত, আশপাশের জমিতে সেচের পানি যেত এখান থেকেই। আজ সেই খাল ‘প্লাস্টিকের ভাগাড়‘ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে, যা পরিবেশ ও জনজীবনের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। শুভাঢ্যা খাল প্লাস্টিকের রাজত্ব ঘোচাতে

শুভাঢ্যার বর্তমান চিত্র: এ যেন এক প্লাস্টিক সমুদ্র!

গত মঙ্গলবার (১৪ মে) প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক শুভাঢ্যা খালের চর কালীগঞ্জ, কালীগঞ্জ বাজার, জোড়া ব্রিজ, খালপাড়, নয়া শুভাঢ্যা, কদমতলী, চরকুতুব, ঝাউবাড়ি, বেগুনবাড়ি, গোলামবাজার, রাজেন্দ্রপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে এসে যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা শিউরে ওঠার মতো। চর কালীগঞ্জ থেকে গোলামবাজার পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে খালের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন। সেখানে এখন শুধু প্লাস্টিক ও বারোয়ারি বর্জ্যের বিশাল স্তূপ। দেখলে মনে হবে যেন বর্জ্য ফেলার জন্যই এই খালটি তৈরি করা হয়েছে।

এই অংশে পানির চিহ্নমাত্র নেই। বর্জ্যে ভরাট হয়ে এতটাই শক্ত হয়ে গেছে যে, মানুষজন ইচ্ছেমতো সাঁকো ছাড়াই হেঁটে এপার থেকে ওপারে চলে যাচ্ছে। পাশে থাকা শত শত শিল্পকারখানা ও দোকানপাটের সব বর্জ্য এখানে ফেলা হয়েছে।

শুধু এক অংশেই নয়, উত্তর শুভাঢ্যা থেকে চিতাখোলা পর্যন্ত খালের অন্য অংশে আবার পলি জমে সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে এখন ঘাস জন্মেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে এককালে গভীর জল ছিল। এর পরের অংশ, অর্থাৎ চিতাখোলা থেকে রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত খালটি সম্প্রতি খনন করা হলেও তার মাটি দুই পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে পানি জমে আছে বটে, কিন্তু সেই পানি প্রবাহের কোনো পথ নেই। অর্থাৎ, খালটি এখনো নিষ্কাশনের কাজ করতে পারছে না।

কেন এই দশা? নেপথ্যের কারণ ও স্থানীয়দের অভিযোগ

শুভাঢ্যা খালের এই মৃত্যুর পেছনে রয়েছে দুটি প্রধান কারণ: অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং নির্বিচার দখল।

১. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: দায় কার?

স্থানীয় বাসিন্দারা ও ব্যবসায়ীরা জানান, পর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকাই খালটিতে বর্জ্য ফেলার অন্যতম প্রধান কারণ। খালপাড় এলাকার বাসিন্দা তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য জমছে, তা সংগ্রহ করার জন্য দিনে মাত্র একবার ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে লোক আসে। এটি চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ব্যবসায়ী ও দোকানিদের অভিযোগ, ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়েই অনেকে খালে ফেলছেন। কদমতলী খালপাড় এলাকার পেঁয়াজ বিক্রেতা আফজাল মিয়া প্রশ্ন তোলেন, “ময়লা তাহলে কোথায় ফেলব?” শুভাঢ্যা খাল প্লাস্টিকের রাজত্ব ঘোচাতে

তাদের এই মন্তব্য একদিকে যেমন দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে, অন্যদিকে তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও তোলে: আসলেই কি তাদের জন্য বর্জ্য ফেলার পর্যাপ্ত ও সহজ বিকল্প ব্যবস্থা আছে? যদি দিনে তিন থেকে চারবার বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো মানুষ এতটা বেপরোয়া হয়ে খালে ময়লা ফেলত না, এমনটাই মনে করেন তোফায়েল আহমেদ। কেরানীগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাতুল মাওয়া অবশ্য জানিয়েছেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক করার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ শুরু করেছেন। তবে সেই কাজের গতি ও কার্যকারিতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।

২. দখল ও ভূমিদস্যুতা: প্রভাবশালী কারা?

জলাশয় দখলের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। শুভাঢ্যা খালের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, খালের পাড়ে বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী মহলের সমর্থনে কাঁচাবাজার ও দোকানপাট বসানো হয়েছে। এই অবৈধ স্থাপনাগুলো শুধু খালের জায়গা দখল করেইনি, এগুলো থেকে উৎপন্ন বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলে দূষণকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, খালের পাশে অবৈধ স্থাপনার তালিকা মাস ছয়েক আগেই করা হয়েছে এবং খাল খননকাজ শুরু হলে এগুলো ভেঙে ফেলা হবে। তবে প্রশ্ন হলো, ছয় মাস ধরে তালিকা হাতে থাকার পরেও কেন এই স্থাপনাগুলো বহাল রয়েছে এবং খাল খনন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করতে হবে? দখলদারদের প্রভাব এখানে কতটা কাজ করছে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

অতীতে ব্যর্থতা, নতুন আশা: ৩১৭ কোটি টাকার প্রকল্প

শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ এবারই প্রথম নয়। অতীতেও এমন চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো টেকসই হয়নি। খাল আবারও দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আগের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি নিয়ে শঙ্কিত। আগানগর এলাকার বাসিন্দা হাসিবুর রহমান বলেন, “এই খাল বাঁচানো মানেই কেরানীগঞ্জকে টিকিয়ে রাখা… আগের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। নতুবা শুভাঢ্যার ভাগ্যে জুটবে আরও কয়েক শ কোটি টাকার ব্যর্থতার গল্প।”

তবে এবার সরকার একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩১৭ কোটি টাকার একটি নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। গত সোমবার (১৩ মে) খালটি পরিদর্শন শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এই প্রকল্পের কথা জানান। তিনি বলেন, এই প্রকল্পে শুধু খাল খননই নয়, পাড় বাঁধাই, ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগামী জুন মাস থেকে কাজ শুরু হয়ে ২০২৬ সালের জুনে শেষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশ্লেষণ: এই উদ্যোগ কি শুভাঢ্যাকে বাঁচাতে পারবে?

নতুন এই প্রকল্প নিঃসন্দেহে শুভাঢ্যা খালকে বাঁচানোর জন্য একটি বড় সুযোগ। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কাজ হওয়ায় কাজের স্বচ্ছতা ও গতি কিছুটা হলেও বাড়বে বলে আশা করা যায়। পাড় বাঁধাই ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ একদিকে যেমন খালের জমি রক্ষা করবে, তেমনই জনগণের জন্য মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করবে এবং খালে সহজে ময়লা ফেলা কঠিন হবে।

তবে এই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। স্থানীয়দের অভিযোগ এবং সরেজমিন চিত্র থেকে স্পষ্ট যে, বর্জ্য ফেলার সুনির্দিষ্ট জায়গা ও পর্যাপ্ত সংগ্রহ ব্যবস্থার অভাবই খালের এই দশার অন্যতম প্রধান কারণ। যদি প্রকল্পের আওতায় টেকসই ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায় – যেমন: প্রতিটি বাড়ি, দোকান ও কারখানার জন্য বর্জ্য রাখার পাত্র সরবরাহ করা, দিনে একাধিকবার বর্জ্য সংগ্রহ করা, সংগৃহীত বর্জ্যকে যথাযথভাবে প্রক্রিয়াজাত বা ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা – তবেই খালের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা সম্ভব। শুধুমাত্র খাল খনন করে লাভ হবে না, যদি চারপাশের মানুষ আগের মতোই এটিকে ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দখল উচ্ছেদ ও প্রতিরোধ। অবৈধ স্থাপনার তালিকা হয়েছে, কিন্তু উচ্ছেদ প্রক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকর হতে হবে। প্রভাবশালী মহলের চাপ প্রতিহত করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কঠোর আইনি পদক্ষেপ জরুরি। উচ্ছেদের পর যাতে আবার দখল না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত মনিটরিং এবং খালের পাড়ে পরিকল্পিত উন্নয়ন (যেমন ওয়াকওয়ে, সবুজায়ন) প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি। মানুষকে বোঝাতে হবে যে খালটি তাদেরই সম্পদ এবং এটি দূষিত হলে ultimately তাদেরই ক্ষতি। বর্জ্য খালে ফেলা যে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন।

চতুর্থত, সমন্বয়হীনতা দূর করা। শুভাঢ্যা খাল বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর সাথে যুক্ত। শুধু খালের ভেতরের অংশ ঠিক করলেই হবে না, এর উৎসমুখ ও মোহনার অবস্থাও ঠিক করতে হবে। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের প্রেক্ষাপট

জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা। শুভাঢ্যার মতো খালগুলো প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। এই খাল ভরাট হয়ে গেলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে, যা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জসহ সংলগ্ন এলাকার জলাবদ্ধতাকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকে আরও কঠিন করে তুলবে।

এছাড়া, প্লাস্টিক দূষণ কেবল খালের সৌন্দর্য নষ্ট করছে না, এটি মাটির উর্বরতা কমাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করছে এবং বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিক সহজে পচে না, মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। শুভাঢ্যা খাল তাই কেবল একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বৃহত্তর চিত্রের একটি অংশ।

শেষ কথা: শুভাঢ্যা কি প্রাণ ফিরে পাবে?

৩১৭ কোটি টাকার প্রকল্প শুভাঢ্যা খালের জন্য একটি নতুন আশার আলো। তবে এই আশা যেন আবারও ব্যর্থতার গল্পে পরিণত না হয়, তার জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের আন্তরিকতা ও কার্যকর পদক্ষেপ। শুধু খাল খনন নয়, দরকার টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দখলদারদের বিরুদ্ধে আপোসহীন অবস্থান এবং সর্বোপরি জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ। শুভাঢ্যা খালের এই যুদ্ধ কেবল প্রকৃতির জন্য যুদ্ধ নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করার যুদ্ধ। এটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করার যুদ্ধ – যেখানে প্রকৃতি ধ্বংস নয়, প্রকৃতিকে বাঁচিয়েই উন্নয়ন সম্ভব।

কেরানীগঞ্জকে টিকিয়ে রাখতে হলে শুভাঢ্যা খালকে বাঁচাতেই হবে। এই বিশাল প্লাস্টিকের ভাগাড় পরিষ্কার করে আবার সেখানে স্বচ্ছ জল ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেই কেবল এই মহৎ উদ্যোগ সফল হবে।

আপনারাও অংশ নিন: শুভাঢ্যা খালের এই পরিস্থিতি নিয়ে আপনার কী মতামত? খালটিকে বাঁচাতে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে আপনি মনে করেন? বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করার জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি? কমেন্ট করে আমাদের জানান এবং এই বিষয়ে আপনার এলাকার মানুষদের সচেতন করুন। একটি জলপথকে বাঁচানো আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। শুভাঢ্যা খাল প্লাস্টিকের রাজত্ব ঘোচাতে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ