সবুজ গাছ মানেই প্রাণ, শীতল ছায়া আর বিশুদ্ধ বাতাস। সড়কের দু’পাশের গাছগুলো যেন প্রকৃতির এক অমূল্য উপহার। তারা শুধু আমাদের পথকেই ছায়া দিয়ে শান্ত রাখে না, পরিবেশের জন্যও তারা নীরবে অনেক কাজ করে যায়। কিন্তু যখন শুনি সেই গাছগুলোকে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। বাকল তুলে গাছের ‘শ্বাসরোধ‘
সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে সড়কের পাশের শতাধিক গাছের এমন করুণ দশা দেখে আমরা উদ্বিগ্ন। গাছের ডালপালা কেটে ফেলার পর রীতিমতো বাকল বা ছাল তুলে নেওয়া হয়েছে, যার ফলে গাছগুলো এখন মৃতপ্রায়। এই ঘটনা শুধু স্থানীয় পরিবেশের জন্যই নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যও এক অশনি সংকেত।
এই পোস্টে আমরা খাগড়াছড়ির এই ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করব, কেন সড়কের পাশের গাছগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কতটা ক্ষতিকর—তা সহজ ভাষায় তুলে ধরব। আপনি যদি গাছপালা, পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত হন, তবে এই আলোচনা আপনার জন্য জরুরি।
খাগড়াছড়ির গাছের কান্না: যেভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে জীবন্ত সত্তাকে
খাগড়াছড়িতে সড়কের পাশে বেড়ে ওঠা শতাধিক গাছকে যেভাবে ডালপালা কেটে এবং বাকল তুলে মৃতপ্রায় করে ফেলা হয়েছে, তা এক ধরনের পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ বলেই মনে হচ্ছে। গাছের বাকল হলো তার সুরক্ষাকবচ। এটি গাছের মূল কাণ্ডের ভেতরের টিস্যুকে রক্ষা করে, পানি ও পুষ্টি পরিবহনে সাহায্য করে এবং রোগ ও কীটপতঙ্গ থেকে গাছকে বাঁচায়। বাকল তুলে গাছের ‘শ্বাসরোধ’
গাছের গোড়ার চারপাশের বাকল সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে তুলে ফেললে গাছের ভেতরের টিস্যুগুলো খোলা জায়গায় আসে, যা পানি ও পুষ্টি পরিবহন প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেয়। এর ফলে গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় এবং মারা যায়। ডালপালা কেটে ফেলা গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং গাছের টিকে থাকার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
এই ধরনের কাজ কারা বা কেন করছে, তা পরিষ্কার নয়। এর পেছনে কাঠ বা বাকল চুরির উদ্দেশ্য থাকতে পারে, অথবা কোনো নির্মাণকাজ বা অন্য কোনো ব্যক্তি স্বার্থের কারণে গাছগুলোকে সরিয়ে ফেলার অসৎ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। কারণ যাই হোক না কেন, এটি একটি অমানবিক এবং পরিবেশবিরোধী কাজ। জীবন্ত গাছকে এভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
সড়কের পাশের গাছগুলো এমনিতেই বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে থাকে—গাড়ির ধাক্কা, রাস্তার সম্প্রসারণ, অপরিকল্পিত নির্মাণ। তার উপর মানুষের এমন নির্মম আচরণ তাদের অস্তিত্বকে আরও বিপন্ন করে তোলে।
সড়কের পাশের গাছ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এরা প্রকৃতির ‘সৈনিক’
আমরা হয়তো অনেকেই সড়কের পাশের গাছগুলোকে সাধারণ মনে করি। কিন্তু পরিবেশের জন্য এদের ভূমিকা অপরিসীম:
- জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। একটি বড় গাছ প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন শোষণ করতে পারে। সড়কের পাশের এই গাছগুলো শহরের বা রাস্তার গাড়ির ধোঁয়া থেকে নির্গত কার্বন শোষণ করে বাতাসে কার্বনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, যা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: গাছ ছায়া প্রদান করে এবং তাদের পাতার মাধ্যমে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে আশেপাশের এলাকা ঠান্ডা রাখে। শহরাঞ্চলের ‘হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট’ কমাতে সড়কের গাছগুলো অপরিহার্য। খাগড়াছড়ির মতো পাহাড়ি বা আধা-পাহাড়ি এলাকায় গরমকালে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে এদের ভূমিকা আরও বেশি।
- বায়ু দূষণ হ্রাস: গাছপালা ধুলাবালি এবং অন্যান্য বায়ু দূষণকারী কণা আটকে রাখে, বাতাসকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। সড়কের পাশের গাছগুলো গাড়ির ধোঁয়া এবং ধুলাকে ফিল্টার করে।
- ভূমি ক্ষয় রোধ: গাছের শিকড় মাটি আঁকড়ে ধরে রাখে, যা সড়কের পাশে এবং ঢালু অঞ্চলে ভূমি ক্ষয় রোধ করে।
- শব্দ দূষণ কমানো: গাছপালা রাস্তার যানবহনের শব্দ শোষণ করে শব্দ দূষণ কমাতে সাহায্য করে।
- জীববৈচিত্র্য: সড়কের পাশের গাছ অনেক পাখি, পোকামাকড় এবং ছোট প্রাণীর আশ্রয়স্থল।
- সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও মানসিক শান্তি: সবুজ গাছপালা রাস্তার সৌন্দর্য বাড়ায় এবং পথচারী ও যাত্রীদের মনে প্রশান্তি এনে দেয়।
খাগড়াছড়িতে শতাধিক গাছের বাকল তুলে ফেলার অর্থ হলো, ঐ এলাকার পরিবেশ তার এই ‘সৈনিকদের’ হারাতে চলেছে। এটি ঐ এলাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ু দূষণ এবং কার্বন শোষণের ক্ষমতা হ্রাস করার কারণ হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনার তাৎপর্য
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে, চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এমন পরিস্থিতিতে গাছ লাগানো এবং বিদ্যমান গাছগুলোকে রক্ষা করা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
যখন খাগড়াছড়ির মতো ঘটনা ঘটে, যেখানে স্রেফ কয়েকজনের লোভ বা অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে শতাধিক পরিণত গাছ মৃতপ্রায় হয়ে যায়, তখন তা আমাদের সমষ্টিগত পরিবেশগত প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেয়। একটি গাছ বড় হতে অনেক বছর সময় লাগে। এই গাছগুলো যে পরিমাণ কার্বন শোষণ করত, বা যে ছায়া প্রদান করত, তা রাতারাতি তৈরি করা সম্ভব নয়।
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় আরও কঠোর নজরদারি এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর এই ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং দায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। জনগণের সচেতনতাও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমাদের করণীয় কী?
খাগড়াছড়ির এই ঘটনাটি একটি দুঃখজনক উদাহরণ। কিন্তু এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমাদের গাছপালা কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং তাদের রক্ষায় আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে।
- নজরদারি বাড়ান: আপনার আশেপাশে সড়কের পাশের বা পাবলিক প্লেসের গাছপালা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত করছে দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: এই ধরনের কাজের ভয়াবহতা সম্পর্কে আপনার প্রতিবেশী ও বন্ধুদের সাথে আলোচনা করুন।
- কর্তৃপক্ষকে চাপ দিন: স্থানীয় প্রশাসন এবং বন বিভাগকে গাছ রক্ষায় আরও সক্রিয় হওয়ার জন্য অনুরোধ করুন। দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য চাপ দিন।
- গাছ লাগান ও পরিচর্যা করুন: সুযোগ পেলেই গাছ লাগান এবং লাগানো গাছের যত্ন নিন।
শেষ কথা: একটি গাছের জীবন মানেই পরিবেশের জন্য শক্তি
খাগড়াছড়িতে সড়কের পাশের শতাধিক গাছকে মৃতপ্রায় করে ফেলার ঘটনা আমাদের পরিবেশের জন্য একটি বড় ক্ষতি। এটি শুধু কয়েকটি গাছের মৃত্যু নয়, এটি ঐ এলাকার পরিবেশের স্বাস্থ্যহানি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের পিছিয়ে পড়া।
এই ঘটনা যেন শুধু একটি খবর হয়েই না থাকে। এটি আমাদের মনে দাগ কাটুক এবং গাছপালা রক্ষায় আমাদের আরও বেশি দায়িত্বশীল করে তুলুক। মনে রাখবেন, একটি গাছ মারা যাওয়া মানে পরিবেশের একজন ‘সৈনিক’ হারানো। বাকল তুলে গাছের ‘শ্বাসরোধ’
আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের চারপাশের গাছগুলোকে রক্ষা করি। ছোট ছোট সচেতনতাই পারে বড় পরিবর্তন আনতে। খাগড়াছড়ির এই ঘটনার প্রতিবাদ করুন এবং গাছ রক্ষায় আপনার করণীয় সম্পর্কে ভাবুন। আপনার মতামত কমেন্ট করে জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি শেয়ার করে অন্যদেরও সচেতন করুন।