বৈশাখের বিদায়লগ্নে প্রকৃতি যেন নতুন রূপে হাজির হচ্ছে, তবে এবার রূপটা বেশ ভীতিকর। তীব্র তাপপ্রবাহের পর এবার শোনা যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের পদধ্বনি। বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যার সম্ভাব্য নাম ‘শক্তি’। বেসরকারি আবহাওয়াবিষয়ক ওয়েবসাইট আবহাওয়া ডট কমের প্রধান আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ এই শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। চলতি মাসেই আঘাত হানার শঙ্কা!
এই ঘূর্ণিঝড়টি কবে আসছে, কতটা শক্তিশালী হতে পারে, এবং কোথায় আঘাত হানতে পারে—সেই পূর্বাভাস তো রয়েছেই। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে একটি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস কেন আমাদের আরও বেশি ভাবায়? এটি কি শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, নাকি পরিবর্তিত পরিবেশের এক নতুন বাস্তবতা? আসুন, এই বিষয়গুলো সহজ ভাষায় বিশ্লেষণ করি।
আপনি যদি পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে চিন্তিত হন, তবে এই পোস্টটি আপনার জন্য।
ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ আসছে? যা বলছে পূর্বাভাস
আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশের পূর্বাভাস অনুযায়ী, মে মাসের ২৭ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে যেকোনো সময় বঙ্গোপসাগরে এই ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তার আগের পূর্বাভাসে ২৬ থেকে ২৯ মে’র কথা উল্লেখ ছিল। অর্থাৎ, চলতি মাসের শেষ দিকেই এর জন্ম হতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এটি কোথায় আঘাত হানবে? পূর্বাভাস অনুযায়ী, সম্ভাব্য এই ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ ২৯ থেকে ৩০ মের মধ্যে ভারতের ওড়িশা উপকূল এবং মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূলের মধ্যবর্তী যেকোনো স্থানে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। বাংলাদেশ উপকূল এই মুহূর্তে সরাসরি আঘাত হানার তালিকায় না থাকলেও, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ যেকোনো সময় পরিবর্তিত হতে পারে এবং এর প্রভাব বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেও পড়তে পারে। চলতি মাসেই আঘাত হানার শঙ্কা!
ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি কেমন হবে? মোস্তফা কামাল পলাশ একটি interesting তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি কেমন হবে, তা নির্ভর করছে একই সময়ে আরব সাগরে সৃষ্ট হতে যাওয়া আরেকটি সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের ওপর। যদি আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ের ১-২ দিন আগেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে ‘শক্তি’ কিছুটা বেশি শক্তিশালী হতে পারে। আবহাওয়া মডেলগুলো বর্তমানে ২৯-৩০ মে’র মধ্যে উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাবনাই বেশি দেখাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কি এই ঝুঁকির কারণ?
একটি নির্দিষ্ট ঘূর্ণিঝড় সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে—এটা বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ঘূর্ণিঝড়ের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর সম্পর্ক নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন এবং বেশ কিছু প্যাটার্ন খুঁজে পেয়েছেন।
- গরম সমুদ্র: পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি এবং শক্তিশালী হওয়ার জন্য উষ্ণ সমুদ্র অন্যতম প্রধান শর্ত। উষ্ণ পানি ঘূর্ণিঝড়কে আরও বেশি শক্তি যোগায়।
- আর্দ্রতা বৃদ্ধি: উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে বাতাসে আর্দ্রতা বা জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের জন্য এটি হলো জ্বালানির মতো।
- সম্ভাব্য তীব্রতা বৃদ্ধি: যদিও ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নাও বাড়তে পারে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শক্তিশালী বা বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেক বিজ্ঞানী। ‘সুপার সাইক্লোন’-এর মতো ঘটনাগুলো হয়তো ভবিষ্যতে আরও ঘন ঘন দেখা যেতে পারে।
তাই, ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ফসল নয়, কিন্তু পরিবর্তিত জলবায়ুতে এমন শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি হয়তো বাড়ছেই। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো এমনিতেই নাজুক, তার উপর যদি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ে, তবে তা পরিবেশ এবং জনজীবনের জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। চলতি মাসেই আঘাত হানার শঙ্কা!
পরিবেশের উপর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব: শুধু ক্ষয়ক্ষতি নয়
ঘূর্ণিঝড় মানেই শুধু ঘরবাড়ি বা ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নয়। এর সুদূরপ্রসারী পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে:
- উপকূলীয় পরিবেশের ক্ষতি: জলোচ্ছ্বাসের কারণে লবণাক্ত পানি ভেতরে ঢুকে মাটি ও মিঠাপানির উৎসকে দূষিত করে, যা কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর। ম্যানগ্রোভ বন (যেমন সুন্দরবন) ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে রক্ষা করলেও, অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এই বনগুলোরও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
- নদী ও জলাভূমির ক্ষতি: ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হতে পারে, পলি জমে নাব্যতা কমে যেতে পারে।
- জীববৈচিত্র্য ধ্বংস: গাছপালা ভেঙে যাওয়া, বাসস্থান নষ্ট হওয়া এবং লবণাক্ততার কারণে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
- মাটি ও পানির দূষণ: বিধ্বস্ত অবকাঠামো, বর্জ্য এবং মৃত প্রাণী থেকে মাটি ও পানি দূষিত হতে পারে।
আমাদের পরিবেশ যদি এমনিতেই বনভূমি উজাড়, নদী দখল, দূষণ এবং অবৈধ উত্তোলনের কারণে দুর্বল থাকে (যেমনটি আমরা আগের পোস্টগুলোতে আলোচনা করেছি), তবে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে যায়। সুস্থ পরিবেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি ঢাল হিসেবে কাজ করে।
প্রস্তুতি ও সচেতনতা: আমাদের করণীয় কী?
যদিও ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র সরাসরি বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানার পূর্বাভাস এই মুহূর্তে নেই, তবে এটি একটি সংকেত। জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। আমাদের সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে।
- তথ্য অনুসরণ করুন: আবহাওয়া অফিসের বা নির্ভরযোগ্য আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদানকারী সংস্থার আপডেটগুলো নিয়মিত অনুসরণ করুন। যেকোনো জরুরি বার্তা বা সতর্কতা গুরুত্ব সহকারে নিন।
- প্রস্তুতি নিন: উপকূলীয় বা দুর্যোগপ্রবণ এলাকার বাসিন্দারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, জরুরি ঔষধপত্র এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতের কাছে রাখুন। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি রাখুন।
- সচেতনতা বাড়ান: আপনার প্রতিবেশী ও কমিউনিটিতে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি এবং মোকাবিলার উপায় সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দিন।
- পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা: দীর্ঘমেয়াদে ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের প্রভাব কমাতে পরিবেশ সুরক্ষায় মনোযোগ দেওয়া জরুরি। গাছ লাগানো, নদী ও বনভূমি রক্ষা করা, দূষণ কমানো—এসব ছোট ছোট পদক্ষেপও সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
শেষ কথা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ এক বাস্তবতা, প্রস্তুতিই সেরা অস্ত্র
ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ আসছে কিনা, আসলেও তা কতটা শক্তিশালী হবে বা কোথায় আঘাত হানবে, তা সময় বলে দেবে। তবে এই পূর্বাভাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা একটি পরিবর্তিত জলবায়ুর যুগে বাস করছি, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।
এই ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি এবং পরিবেশ সচেতনতা অপরিহার্য। শুধু ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পেলেই নয়, সারাবছরই আমাদের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করতে হবে। একটি শক্তিশালী পরিবেশই আমাদের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
আশা করি এই তথ্য আপনাকে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র সম্ভাব্য আগমন এবং এর পরিবেশগত তাৎপর্য বুঝতে সাহায্য করেছে। আবহাওয়া আপডেটের দিকে নজর রাখুন এবং নিরাপদ থাকুন। এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি শেয়ার করে অন্যদেরও সচেতন করুন। আপনার এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে? কমেন্ট করে আপনার অভিজ্ঞতা জানান।