ফারাক্কা বাঁধ নামটি শুনলেই আমাদের দেশের মানুষ, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের নদী পাড়ের মানুষের মনে এক ধরনের চাপা কষ্ট আর ক্ষোভ জেগে ওঠে। এই বাঁধ গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এবং তাদের অসংখ্য শাখা নদীর উপর। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, কৃষিতে ক্ষতি হয়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়, এবং সামগ্রিকভাবে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফারাক্কার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন
২০২৬ সালের ডিসেম্বরে ফারাক্কার পানিবণ্টন চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হবে। এই প্রেক্ষাপটে পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা একইসাথে ফারাক্কা ইস্যু, দেশের নদীগুলোর অবস্থা এবং পরিবেশ রক্ষার সামগ্রিক প্রচেষ্টার সাথে সম্পর্কিত।
এই পোস্টের মূল উদ্দেশ্য হলো রিজওয়ানা হাসানের এই কথাগুলোকে বিশ্লেষণ করা, কেন ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন থেকে শুরু করে বড়ালের মতো নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনা এবং অবৈধভাবে বালু/মাটি উত্তোলন বন্ধ করা—এই সব বিষয় আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত—তা সহজ ভাষায় আপনাদের সামনে তুলে ধরা। আপনি যদি দেশের নদী, পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত হন, তাহলে এই আলোচনা আপনার জন্য অত্যন্ত জরুরি। ফারাক্কার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন
ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন: ন্যায্য হিস্যার লড়াই
রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে ফারাক্কা চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে এবং এটি নবায়নের জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। কারণ এই চুক্তিটি নবায়ন হওয়ার সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেন আমাদের “ন্যায্য হিস্যা” নিশ্চিত করা হয়, তা দেখা জরুরি।
কেন এই ন্যায্য হিস্যা জরুরি? কারণ গঙ্গা নদীর পানি আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য জীবনরেখা। শুষ্ক মৌসুমে যদি পর্যাপ্ত পানি না আসে, তাহলে ঐ এলাকার কৃষি, শিল্প, নৌচলাচল, মৎস্য সম্পদ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফারাক্কার কারণে সৃষ্ট পানির স্বল্পতা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামিয়ে দিয়েছে, লবণাক্ততা বাড়িয়ে দিয়েছে সুন্দরবনের মতো সংবেদনশীল এলাকায়, এবং অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে।
রিজওয়ানা হাসানের এই বার্তাটি আশাব্যঞ্জক যে, চুক্তির দেড় বছর মেয়াদ বাকি থাকতেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশ তার অধিকারের জায়গা থেকে কথা বলবে। সঠিক তথ্য-উপাত্ত এবং বলিষ্ঠ অবস্থানই পারে একটি ভালো চুক্তি নিশ্চিত করতে, যা আমাদের পরিবেশ এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্য লাভজনক হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনিতেই নদীর পানিপ্রবাহে অনিশ্চয়তা বাড়ছে, এই পরিস্থিতিতে একটি ন্যায্য ও কার্যকর পানি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
বড়াল নদীর পুনর্জীবন: প্রাকৃতিক উপায় ও জনগণের মতামত
ফারাক্কার প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে রিজওয়ানা হাসান বড়াল নদীর প্রসঙ্গও তুলে ধরেছেন। এটিও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ফারাক্কার মতো বড় আন্তর্জাতিক সমস্যার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর অবস্থাও আমাদের পরিবেশের জন্য সমানভাবে উদ্বেগজনক। বড়াল নদীর মতো অনেক নদীই দখল, দূষণ এবং অপরিকল্পিত বাঁধ বা স্লুইসগেটের কারণে মৃতপ্রায়। ফারাক্কার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন
বড়াল নিয়ে তার বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট:
- প্রাকৃতিক উপায়ে পুনরুদ্ধার: তিনি “প্রাকৃতিকভাবে বড়াল নদীর কতটুকু আমরা ফেরত আনতে পারি” সেদিকে জোর দিয়েছেন। এটি অতীতের সেই প্রকৌশল-নির্ভর এবং প্রায়শই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বড় প্রকল্পের ধারা থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দেয়। নদীর নিজস্ব প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে, বাধাগুলো দূর করে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করাটা পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই হতে পারে।
- চারঘাট স্লুইসগেট ও ১৮ কিমি খনন: বড়ালের উৎসমুখে চারঘাট স্লুইসগেটটি সরানো যায় কিনা এবং আটঘরিয়ার দিকে ১৮ কিমি খনন করে প্রবাহ আনা যায় কিনা—এসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। যদি স্লুইসগেটটি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দেয়, তবে এটি অপসারণ করা প্রাকৃতিক উপায়।
- পাউবোর সমালোচনা ও সমন্বয়ের আহ্বান: তিনি সরাসরি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) শত শত কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যর্থতা এবং তাদের “একচ্ছত্র ক্ষমতা”র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা নদী ভাঙন রক্ষার জন্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হয়তো দরকার, কিন্তু নদীকে মেরে ফেলা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি পাউবোকে পরিবেশ অধিদপ্তর, নদী রক্ষা কমিশন এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে “ব্যয় সাশ্রয়ী” এবং “প্রাকৃতিক সিস্টেম হিসেবে দেখেই” পরিকল্পনা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
- জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া: এটি সম্ভবত তার বক্তব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি বলেছেন, পাউবোকে “কোথায় তাকে মানুষের কথা শুনতে হবে” তা জানতে হবে। প্রকল্পগুলো জনগণের স্বার্থে হয়, তাই জনগণের মতামত প্রতিফলিত হতে হবে। এটি নদী উদ্ধারের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের অভিজ্ঞতা এবং চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার একটি বার্তা, যা প্রায়শই সরকারি প্রকল্পগুলোতে অনুপস্থিত থাকে।
বড়াল নদীর এই প্রচেষ্টা যদি সফল হয়, তবে তা বাংলাদেশের অন্যান্য মৃতপ্রায় নদীগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ তৈরি করবে। নদী বাঁচানো মানে ঐ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, কৃষি, পানির উৎস এবং স্থানীয় জলবায়ুকে সুস্থ রাখা। এটি সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সাহায্য করে।
অবৈধ বালু উত্তোলন ও পাহাড় কাটা: লোভের ভয়ংকর অনিয়ম
ফারাক্কা এবং বড়াল নদীর পাশাপাশি রিজওয়ানা হাসান দেশের আরেকটি ভয়ংকর পরিবেশগত সমস্যা – অবৈধ বালু উত্তোলন, পাহাড় কাটা এবং কৃষিজমির টপসয়েল কেটে নেওয়া – নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি এই কাজগুলোকে “চরম লোভনীয়” এবং “ভয়ংকর অনিয়ম” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং স্বীকার করেছেন যে এটি “চরম পর্যায়ে চলে গেছে”।
এই অবৈধ কার্যকলাপগুলো পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে:
- নদী ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট: অবৈধভাবে বালু তোলার ফলে নদীর পাড় ভাঙে, গতিপথ পরিবর্তন হয়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয় এবং পানির মান খারাপ হয়। এটি পুরো নদী বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করে দেয়।
- পাহাড় ও মাটির ক্ষয়: পাহাড় কাটার ফলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে, মাটির ক্ষয় হয় এবং প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ নষ্ট হয়।
- কৃষিজমির ক্ষতি: কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি (টপসয়েল) সরিয়ে নেওয়ার ফলে জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে, যা খাদ্য সুরক্ষার জন্য হুমকি।
রিজওয়ানা হাসানের বার্তা অনুযায়ী, সরকার এই অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে “শক্ত অবস্থান” নিয়েছে। ৬৪ জেলার ডিসি এবং এসপিদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে এবং তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ১০ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাতের বেলায়ও অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং জেলা প্রশাসনগুলোকে মনিটর করা হচ্ছে।
অবৈধ উত্তোলন বন্ধ করা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরাসরি সাহায্য করে। এটি ভূমি ক্ষয় রোধ করে, নদীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে এবং আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে সুরক্ষিত রাখে।
একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি: পরিবেশ, নদী ও মানুষের যোগসূত্র
রিজওয়ানা হাসানের এই বিভিন্নমুখী বক্তব্য থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, তিনি পরিবেশ এবং পানিসম্পদ সমস্যাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখছেন না। ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন (আন্তর্জাতিক), বড়াল নদীর পুনরুদ্ধার (অভ্যন্তরীণ নদী), এবং অবৈধ উত্তোলন বন্ধ (ভূমি ও সম্পদ সুরক্ষা) – এই সব বিষয় আসলে একই সূত্রে গাঁথা। প্রতিটিই আমাদের পরিবেশের স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং সর্বোপরি মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে জড়িত।
তার বক্তব্যে ‘প্রাকৃতিক উপায়’, ‘সমন্বিত চেষ্টা’ এবং ‘জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া’ – এই দিকগুলো একটি নতুন এবং ইতিবাচক ধারার ইঙ্গিত দেয়। অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও টেকসই এবং জনবান্ধব সমাধানের দিকে যাওয়ার এটি একটি প্রচেষ্টা।
তবে এই প্রচেষ্টা সফল হবে কিনা তা নির্ভর করে এর বাস্তবায়নের উপর। শুধু নির্দেশনা দেওয়াই যথেষ্ট নয়, মাঠ পর্যায়ে এর কঠোর প্রয়োগ এবং ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোর লোভ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হবে না।
শেষ কথা: আমাদের নদী, আমাদের পরিবেশ, আমাদের ভবিষ্যৎ
ফারাক্কার ন্যায্য পানি হিস্যা, বড়ালের মতো মৃতপ্রায় নদীর পুনর্জীবন এবং অবৈধ উত্তোলন বন্ধ – এই সবগুলোই বাংলাদেশের পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। রিজওয়ানা হাসানের বার্তাটি আশাব্যঞ্জক, কারণ এটি সমস্যাগুলোর গভীরতা স্বীকার করে এবং সমাধানের জন্য কিছু নতুন এবং সমন্বিত পদ্ধতির কথা বলে। বিশেষ করে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।
আমাদের দেশের নদীগুলো শুধু পানির উৎস নয়, তারা আমাদের সংস্কৃতির অংশ, অর্থনীতির ভিত্তি এবং পরিবেশের প্রাণ। এই নদীগুলোকে বাঁচানো মানে আসলে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে আমাদের নদী, বন এবং ভূমিকে সুস্থ রাখা অপরিহার্য।
এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি শেয়ার করে অন্যদেরও সচেতন করুন। আপনার কি মনে হয় এই নতুন প্রচেষ্টাগুলো সফল হবে? আপনার এলাকার নদী বা পরিবেশের অবস্থা কেমন? কমেন্ট করে আপনার মতামত জানান। আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার হই এবং এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাই।