আমাদের দেশ নদীমাতৃক। এই কথাটা শুধু বইয়ের পাতায় নয়, এটা আমাদের জীবনের অংশ ছিল একসময়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় অনেক নদী আজ মৃতপ্রায়, তাদের বুকে এখন ফসলের ক্ষেত বা শুকনো বালুচর। বড়াল নদী তেমনই এক মৃতপ্রায় নদী। একসময় যার খরস্রোত ছিল, সেই নদী এখন ধুঁকছে। মৃতপ্রায় বড়াল কি প্রাণ ফিরে পাবে
কিন্তু আশার কথা শোনাচ্ছেন পানি সম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নাকি সমন্বিত চেষ্টায় প্রাকৃতিক উপায়ে বড়াল নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে। এটা কি শুধু কথার কথা, নাকি সত্যিই নদীর পাড়ের মানুষের জন্য এবং সামগ্রিকভাবে পরিবেশের জন্য একটি নতুন ভোরের ইঙ্গিত?
এই পোস্টের উদ্দেশ্য হলো রিজওয়ানা হাসানের এই বার্তাটিকে বিশ্লেষণ করা, কেন বড়াল নদীর মতো মৃতপ্রায় নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনা আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে জরুরি, এবং এই “প্রাকৃতিক উপায়” বা “সমন্বিত চেষ্টা”র গুরুত্ব কোথায় – তা সহজ ভাষায় আপনাদের সামনে তুলে ধরা। আপনি যদি দেশের নদ-নদী, পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত হন, তাহলে এই আলোচনা আপনার জন্য। মৃতপ্রায় বড়াল কি প্রাণ ফিরে পাবে
বড়াল নদীর কান্না: কীভাবে প্রাণ হারালো একটি জীবন্ত সত্তা?
একসময়ের প্রমত্তা বড়াল নদী দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলধারা। এটি রাজশাহীর চারঘাট হয়ে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আটঘরিয়ার কাছে বড়াল মোহনায় গিয়ে মিশেছে। এই নদী শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই ছিল না, এটি ছিল এলাকার কৃষি, মৎস্য সম্পদ এবং ভূগর্ভস্থ পানির মূল উৎস। এর আশেপাশে গড়ে উঠেছিল জীববৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার।
কিন্তু গত কয়েক দশকে বড়াল তার সেই রূপ হারিয়েছে। এর মৃত্যুর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে:
- অবকাঠামোগত হস্তক্ষেপ: নদীর মুখে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণ, বাঁধ দেওয়া ইত্যাদি নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। চারঘাটের মোহনার স্লুইসগেটটি এর অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
- দখল ও দূষণ: নদীর পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে স্থাপনা, শিল্পকারখানার বর্জ্য ও গৃহস্থালির আবর্জনা ফেলে নদীকে দূষিত করা হয়েছে।
- পলি জমা ও খননের অভাব: পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর তলদেশে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। সময়মতো কার্যকর খনন না হওয়ায় নদী নাব্যতা হারিয়েছে।
- উজানে পানি প্রত্যাহার: উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে নদীর প্রবাহ কমে গেছে।
একটি নদীর মৃত্যু মানে শুধু তার ভৌগলিক অস্তিত্ব বিলীন হওয়া নয়, এর সুদূরপ্রসারী পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে:
- ভূগর্ভস্থ পানির স্তর: নদী শুকিয়ে গেলে আশেপাশের এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, যা কৃষি ও জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
- জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: নদীর ওপর নির্ভরশীল উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়। মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হয়।
- কৃষিতে প্রভাব: সেচের জন্য পানির অভাব দেখা দেয়, জমির উর্বরতা কমে যায়।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বৃদ্ধি: নদী বা জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া মানে ঐ এলাকার আদ্রতা কমে যাওয়া, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং মরুকরণের ঝুঁকি বাড়ায়। নদীমাতৃক দেশের জলবায়ু স্থিতিশীল রাখতে নদীর ভূমিকা অপরিসীম।
সুতরাং, বড়াল নদীর মতো একটি নদীর মৃত্যু শুধু একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে একটি বড় উদ্বেগ। মৃতপ্রায় বড়াল কি প্রাণ ফিরে পাবে
রিজওয়ানা হাসানের বার্তা: ‘প্রাকৃতিক উপায়’ ও ‘সমন্বিত চেষ্টা’র মাহাত্ম্য
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বড়াল নদী পরিদর্শন এবং তার বক্তব্য কয়েকটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ:
১. ‘প্রাকৃতিক উপায়’ :
তিনি জোর দিয়েছেন ‘প্রাকৃতিকভাবে’ নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার ওপর। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অতীতে নদী উদ্ধারের নামে প্রায়শই বড় বড় প্রকৌশল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যেমন ড্রেজিং (খনন), বাঁধ নির্মাণ বা আরও স্লুইসগেট বসানো। অনেক সময় এই প্রকল্পগুলো পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করেছে এবং নদীর প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রকে আরও disrupted করেছে। ‘প্রাকৃতিক উপায়ে’ নদী উদ্ধারের অর্থ হতে পারে:
- নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য বাধাগুলো (যেমন স্লুইসগেট) অপসারণ করা।
- নদীর উৎসমুখ বা সংযোগস্থলগুলো পরিষ্কার করা যাতে পানি প্রবেশ করতে পারে।
- নদীর পাড়ের পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা, গাছ লাগানো ইত্যাদি।
- নদীর নিজস্ব প্রক্রিয়াকে কাজ করতে দেওয়া, কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ কমানো।
প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে নদী পুনরুদ্ধার প্রায়শই কম ব্যয়বহুল হয় এবং পরিবেশের জন্য বেশি টেকসই। এটি নদীর নিজস্ব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাকে পুনরুজ্জীবিত হতে সাহায্য করে।
২. ‘সমন্বিত চেষ্টা’ :
তিনি স্বীকার করেছেন যে এককভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নদী রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে, শত শত কোটি টাকা খরচ করেও কাজ হয়নি। এটি একটি বাস্তববাদী এবং সাহসী স্বীকারোক্তি। পাউবোর ‘একচ্ছত্র ক্ষমতা’র সমালোচনা করে তিনি নদী রক্ষা কমিশন, পরিবেশ রক্ষা কমিশন এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ‘সমন্বিত চেষ্টা’র কথা বলেছেন। এটি অত্যন্ত জরুরি। নদী একটি জটিল বাস্তুতন্ত্র, যার সাথে ভূমি, পানি, পরিবেশ, স্থানীয় জীবন-জীবিকা সবকিছু জড়িত। শুধু একটি প্রকৌশল সংস্থা দিয়ে এর সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন সকল অংশীদারের সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। এটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতেও সাহায্য করতে পারে।
৩. ‘ব্যয় সাশ্রয়ী পরিকল্পনা’ :
শত শত কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যর্থতার কথা মাথায় রেখে তিনি ব্যয় সাশ্রয়ী পরিকল্পনার কথা বলেছেন। এটি শুধু আর্থিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি প্রায়শই অপ্রয়োজনীয় বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বড় অবকাঠামো নির্মাণ এড়িয়ে চলার ইঙ্গিত দেয়। প্রাকৃতিক উপায়ে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনা সাধারণত বড় বড় কংক্রিটের কাঠামো নির্মাণের চেয়ে কম ব্যয়বহুল হয়।
স্লুইসগেট অপসারণ এবং উৎসমুখ খননের মতো নির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, যা সরাসরি নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনার সাথে সম্পর্কিত। পাবনার ১৮ কিলোমিটার মৃতপ্রায় বড়াল নদীকে পুনরুজ্জীবিত করার পরামর্শও একটি ইতিবাচক দিক।
চ্যালেঞ্জ কী এবং কেন জনগণের সচেতনতা জরুরি?
রিজওয়ানা হাসানের বার্তা আশাব্যঞ্জক হলেও, এই পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বড়াল নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- বাধা অপসারণের বাস্তবায়ন: স্লুইসগেট অপসারণ বা উৎসমুখ খনন সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান, অর্থায়ন এবং স্থানীয় সমর্থন প্রয়োজন।
- দখলদার উচ্ছেদ: নদীর পাড় দখল করে যারা স্থাপনা বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তাদের উচ্ছেদ করা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি কঠিন কাজ হতে পারে।
- সমন্বয়ের কার্যকারিতা: একাধিক সরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সত্যিকারের সমন্বয় কতটা সম্ভব হবে, তা দেখার বিষয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটি বড় বাধা হতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ: শুধু উদ্ধার করলেই হবে না, নদীর সুস্থ প্রবাহ বজায় রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন বা খরা পরিস্থিতি নদী পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলতে পারে।
এই পর্যায়ে জনগণের সচেতনতা এবং সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। কেন? কারণ:
- চাপ সৃষ্টি: জনগণ সোচ্চার হলে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নদী উদ্ধারে আরও বেশি মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়।
- দখল রোধ: স্থানীয় জনগণ সচেতন হলে নতুন দখল প্রতিরোধ করা সহজ হয়।
- সংরক্ষণে অংশগ্রহণ: নদীর পাড়ে বৃক্ষরোপণ বা নদী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার মতো কাজে স্থানীয় জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারে।
- পর্যবেক্ষণ: জনগণ উদ্ধার কাজ এবং সরকারি পদক্ষেপগুলো পর্যবেক্ষণ করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই অংশ। সুস্থ নদী মানে সুস্থ পরিবেশ, আর সুস্থ পরিবেশ মানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি।
শেষ কথা: একটি নদীর জীবন মানে হাজারো প্রাণের স্পন্দন
বড়াল নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুধু একটি নদীর ভৌগলিক অস্তিত্ব রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি দেশের জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। রিজওয়ানা হাসানের ‘প্রাকৃতিক উপায়’ এবং ‘সমন্বিত চেষ্টা’র ধারণাগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা বাংলাদেশের অন্যান্য মৃতপ্রায় নদী উদ্ধারের জন্য একটি মডেল হতে পারে।
শত শত কোটি টাকা খরচ করেও পাউবো কেন ব্যর্থ হয়েছিল, সেই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। আশা করা যায়, নতুন সমন্বিত পদ্ধতি অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেবে এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করবে।
একটি নদীর ফিরে আসা মানে ঐ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবন-জীবিকায় নতুন স্পন্দন ফিরে আসা। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
আসুন, আমরা বড়াল নদীর এই পুনর্জন্মের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করি। নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। এবং মনে রাখি, প্রতিটি নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনা মানেই আসলে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আপনার এলাকার নদীর অবস্থা কেমন? আপনি কি মনে করেন এই নতুন প্রচেষ্টা সফল হবে? কমেন্ট করে আপনার মতামত জানান। এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি শেয়ার করে অন্যদেরও সচেতন করুন।