কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে সোয়া দুই কোটিরও বেশি কৃষক আমাদের খাদ্যের জোগান দেন, অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ব্যবহার আর নানা সীমাবদ্ধতা তাদের জীবনকে করে তোলে অনিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখাচ্ছে ‘উত্তম কৃষি চর্চা’। এর মাধ্যমে শুধু কৃষকের ভাগ্যই বদলাবে না, রক্ষা পাবে পরিবেশও। বদলাচ্ছে সোয়া ২ কোটি কৃষকের জীবন ও পরিবেশ
সম্প্রতি কুমিল্লার বার্ড সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত একটি আঞ্চলিক কর্মশালায় বক্তারা সেই সম্ভাবনার কথাই জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ সরকারের ‘প্রোগ্রাম অন অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্ট্রাপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার)’ প্রকল্পের আওতায় আয়োজিত এই কর্মশালা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বদলাচ্ছে সোয়া ২ কোটি কৃষকের জীবন ও পরিবেশ
উত্তম কৃষি মানে কী? কেন এটা এত জরুরি?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, উত্তম কৃষি হলো এমন এক বিজ্ঞানসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ পদ্ধতি যা একদিকে যেমন ফসলের উৎপাদন বাড়ায়, খরচ কমায়, মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখে, তেমনি উৎপাদিত ফসলকে করে তোলে নিরাপদ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন। কর্মশালায় বক্তারা এর যে মূল সুবিধাগুলো তুলে ধরেছেন, সেগুলো হলো:
১. বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন: রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের মাটি, পানি এবং খাদ্যকে দূষিত করছে। উত্তম কৃষি চর্চায় জৈব সার, বালাইনাশক এবং সমন্বিত রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা হয়, যা বিষমুক্ত ফসল নিশ্চিত করে। ভাবুন তো, আপনার প্লেটে যে খাবারটি আসছে, সেটি সম্পূর্ণ নিরাপদ – কী দারুণ অনুভূতি!
২. কমবে রোগ ব্যাধি: বিষমুক্ত খাবার খাওয়া মানেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকর জীবন। পাশাপাশি, জমিতে রাসায়নিক কম ব্যবহার হলে কৃষকের নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমে আসে।
৩. কমবে উৎপাদন খরচ, বাড়বে লাভ: রাসায়নিক সারের দাম বেশি। উত্তম কৃষি চর্চায় জৈব পদ্ধতি ব্যবহারে খরচ অনেকটাই কমানো সম্ভব। একদিকে খরচ কমছে, অন্যদিকে বিষমুক্ত ও উন্নত মানের ফসলের ভালো দাম পাওয়া যায়। ফলে কৃষি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়।
৪. কৃষি পণ্য হবে রপ্তানিযোগ্য: বিশ্বজুড়েই নিরাপদ ও অর্গানিক পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে উৎপাদিত মানসম্মত ফসল সহজেই বিদেশে রপ্তানি করা যাবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৫. বদলাবে সোয়া দুই কোটি কৃষকের জীবনযাত্রা: লাভজনক কৃষি, স্বাস্থ্যকর জীবন আর উন্নত পরিবেশ – এই সবকিছুই প্রত্যক্ষভাবে সোয়া দুই কোটির বেশি কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। তাদের আয় বাড়বে, পরিবারে সচ্ছলতা আসবে, সন্তানদের ভালো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষায় উত্তম কৃষির ভূমিকা
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষির জন্য এক বিরাট হুমকি। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি – এসবের প্রভাবে ফসলহানি এখন নিয়মিত ঘটনা। উত্তম কৃষি চর্চা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষভাবে উপযোগী। বদলাচ্ছে সোয়া ২ কোটি কৃষকের জীবন ও পরিবেশ
- মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা: রাসায়নিক সার মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দেয়। জৈব সার মাটির গঠন উন্নত করে, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায় এবং অণুজীবদের বাঁচিয়ে রাখে, যা মাটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সহ্য করতে সাহায্য করে।
- পানি সাশ্রয়: উত্তম কৃষি পদ্ধতিতে পানির অপচয় কমানোর নানা উপায় অবলম্বন করা হয়। পরিবর্তিত জলবায়ুতে যখন পানির প্রাপ্যতা অনিশ্চিত, তখন এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।
- কার্বন নিঃসরণ হ্রাস: রাসায়নিক সার উৎপাদনে প্রচুর শক্তি লাগে এবং এর ব্যবহার কার্বন নিঃসরণ ঘটায়। জৈব পদ্ধতিতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়।
- জীববৈচিত্র্য রক্ষা: পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ পদ্ধতি উপকারী পোকা, পাখি এবং অন্যান্য জীবের জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে, যা সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জরুরি।
কুমিল্লার কর্মশালায় বক্তাদের কথায় এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোই উঠে এসেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, পার্টনার প্রকল্পের কর্মকর্তারা এবং কৃষকরা নিজেরা তাদের অভিজ্ঞতা ও ভাবনা জানিয়েছেন।
চ্যালেঞ্জগুলো কী? সমাধানই বা কোথায়?
উত্তম কৃষির সুফল ব্যাপক হলেও এর পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা বাস্তবতার নিরিখে সেই চ্যালেঞ্জগুলোও তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে অন্যতম:
- প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব: উত্তম কৃষি চর্চার জন্য কিছু বিশেষ যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়, যা অনেক কৃষকের কাছে সহজলভ্য নয়।
- জলাবদ্ধতা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ফসল উৎপাদন ব্যাহত করে। এর কার্যকর সমাধান জরুরি।
- কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণ: সনাতন পদ্ধতির বাইরে নতুন কিছু গ্রহণ করতে কৃষকদের সময় লাগে। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, উত্তম কৃষির সুফল সম্পর্কে হাতে-কলমে দেখানো এবং সফল কৃষকদের খামার পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্মশালায় ‘উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ আয়োজনের ওপর গুরুত্ব প্রদান’ এই বিষয়টিকেই নির্দেশ করে।
কর্মশালায় এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়েও আলোচনা হয়েছে। পার্টনার প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলো কৃষকদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে উত্তম কৃষি চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে।
বদলের পথে বাংলাদেশের কৃষি
উত্তম কৃষি চর্চা কেবল একটি উন্নত চাষ পদ্ধতি নয়, এটি বাংলাদেশের কৃষিকে ভবিষ্যৎমুখী করার একটি সামগ্রিক প্রচেষ্টা। এটি একদিকে যেমন কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তি আনবে, তেমনি নিশ্চিত করবে আমাদের সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং রক্ষা করবে পরিবেশের ভারসাম্য। সোয়া দুই কোটি কৃষকের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়া মানে গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি আরও মজবুত হওয়া, দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়া এবং সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়া।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উত্তম কৃষি চর্চা আমাদের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। এই পথ ধরেই বাংলাদেশের কৃষি হবে আরও টেকসই, লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব।
শেষ কথা
উত্তম কৃষি শুধু কৃষকের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। নিরাপদ খাদ্য আমাদের সবার প্রয়োজন, সুস্থ পরিবেশও কাম্য। এই বিশাল পরিবর্তন রাতারাতি হবে না। প্রয়োজন সরকারি সহায়তা, কৃষি বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা, এবং সর্বোপরি কৃষকদের আন্তরিক অংশগ্রহণ।
কুমিল্লার এই আঞ্চলিক কর্মশালা উত্তম কৃষির গুরুত্ব এবং সম্ভাবনাকে নতুন করে সামনে এনেছে। এই আলোচনার ফলাফল মাঠ পর্যায়ে দ্রুত পৌঁছে যাক এবং সোয়া দুই কোটি কৃষকের ভাগ্যে বদলের ছোঁয়া লাগুক – এইটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আপনার কী মনে হয়? উত্তম কৃষি কি সত্যিই বাংলাদেশের কৃষকের জীবন বদলে দিতে পারে? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এর ভূমিকা নিয়ে আপনার ভাবনা কী? কমেন্ট করে জানান আপনার মূল্যবান মতামত।