27.4 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুন ৩, ২০২৫
spot_img

চিংড়ি ঘেরের জন্য পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে অমূল্য বন!

কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ। প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি, যেখানে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বা প্যারাবনের এক অমূল্য ভাণ্ডার। এটি একটি প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ECA), যা এর অনন্য জীববৈচিত্র্য আর পরিবেশগত গুরুত্বের জন্য বিশেষ সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য। অথচ, এই দ্বীপেই চলছে প্যারাবন ধ্বংসের এক ভয়াবহ কর্মকাণ্ড। কেওড়া, বাইনের মতো ম্যানগ্রোভ গাছ কেটে, পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন চিংড়িঘের। আর এই ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয়ভাবে পরিচিত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যাদের অনেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত। পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে অমূল্য বন

এই ঘটনা কেবল সোনাদিয়ার পরিবেশকেই নয়, এটি উপকূলীয় অঞ্চলের সুরক্ষা, জীববৈচিত্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে আমাদের টিকে থাকার লড়াইয়ের এক বড় প্রশ্ন। কেন থামানো যাচ্ছে না এই ধ্বংসলীলা? ক্ষমতার দাপট কি পরিবেশ আইনের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে? পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে অমূল্য বন

সোনাদিয়ার বুকে ক্ষতচিহ্ন: প্যারাবনের মৃত্যু

সোনাদিয়ার প্যারাবন বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য এক প্রাকৃতিক ঢাল। এটি একদিকে যেমন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলকে রক্ষা করে, তেমনি এটি বহু প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া, পাখি এবং অন্যান্য জলজ ও স্থলজ প্রাণীর আবাসস্থল। কার্বন শোষণেও ম্যানগ্রোভ বন অসাধারণ ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই অমূল্য সম্পদকে ধ্বংস করা হচ্ছে ব্যক্তিগত লাভের জন্য। বিশেষ করে চিংড়ি চাষের মতো লাভজনক ব্যবসার প্রসার ঘটাতে নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। শুধু কাটা নয়, অভিযোগ উঠেছে যে এবার প্রকাশ্যে পেট্রল ঢেলে গাছপালা পুড়িয়ে নতুন ঘের তৈরি করা হয়েছে – যা চরম অমানবিক এবং পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর।

সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত এক হাজার একরের প্যারাবন ধ্বংস করে সাতটি নতুন চিংড়িঘের তৈরি হয়েছে। এর আগেও এখানে প্রায় ৩ হাজার একরের বেশি ম্যানগ্রোভ বন নষ্ট করে ৩৭টি চিংড়িঘের হয়েছিল। সব মিলিয়ে এখন সোনাদিয়ায় চিংড়িঘেরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮টি। মাত্র কয়েক দিনে আরও কয়েকশ একর প্যারাবন দখল করে নতুন ঘের তৈরি হয়েছে বলেও জানা গেছে। এই দ্রুত ধ্বংসযজ্ঞ প্রমাণ করে যে একদল প্রভাবশালী ব্যক্তি পরিবেশ আইনকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে চলেছে। পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে অমূল্য বন

আইনি পদক্ষেপ: কতটা কার্যকর হবে?

পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করা একটি সরকারি সংস্থা এই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। স্থানীয় থানায় দায়ের করা মামলায় ২০ জনেরও বেশি পরিচিত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যাদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতি জড়িত বলে খবরে প্রকাশ। এছাড়া আরও ২৫-৩০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় প্রাকৃতিক প্যারাবন ধ্বংস করা, বাঁধ নির্মাণ করে চিংড়িঘের তৈরি করা, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা এবং ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা পরিবেশ আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন অনুযায়ী এই মামলার তদন্ত করবে পরিবেশ বিষয়ক কর্তৃপক্ষ নিজেই।

তবে প্রশ্ন হলো, এই আইনি পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হবে? অতীতেও সোনাদিয়ার প্যারাবন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল এবং উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু সেই অভিযান স্থায়ী ফল দেয়নি। প্রভাবশালী মহলের চাপে বা অন্য কোনো কারণে উচ্ছেদ অভিযান থেমে যায় বা দখলদাররা আবার ফিরে আসে। এবার যখন মামলার আসামিদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও রয়েছেন, তখন এই মামলা কতটা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বা অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে কিনা, তা নিয়ে পরিবেশ সচেতন মহলে সংশয় থেকেই যায়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের উপর প্রভাব

সোনাদিয়ার প্যারাবন ধ্বংস কেবল একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে।

  1. উপকূলীয় দুর্বলতা বৃদ্ধি: প্যারাবন উপকূলকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে রক্ষা করে। প্যারাবন ধ্বংস হয়ে গেলে উপকূলীয় অঞ্চল আরও অরক্ষিত হয়ে পড়ে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
  2. জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়: প্যারাবন বহু প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষেত্র এবং পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই বন ধ্বংস হলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা পুরো বাস্তুতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে যখন প্রাণীকুল এমনিতেই চাপে থাকে, তখন তাদের আবাসস্থল ধ্বংস করা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে।
  3. কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি: প্যারাবন বিপুল পরিমাণ কার্বন শোষণ করে মাটিতে জমা রাখে। বন পুড়িয়ে ফেলা বা কেটে ফেললে সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়, যা গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সরাসরি অবদান রাখে।
  4. লবণাক্ততা বৃদ্ধি: ম্যানগ্রোভ বন মাটির লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। বন ধ্বংস হলে মাটিতে লবণাক্ততা বাড়ে, যা অন্য গাছপালা জন্মানোর জন্য অনুপযোগী করে তোলে এবং কৃষি ও মিঠাপানির উৎসকে প্রভাবিত করে।

এই প্রেক্ষাপটে সোনাদিয়ার প্যারাবন ধ্বংস করা মানে নিজেদের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলা। এটি প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ, যার ফল ultimately আমাদেরই ভোগ করতে হবে।

প্রভাবশালীদের দাপট বনাম পরিবেশ সুরক্ষা

যখন কোনো প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় আইন ভেঙে পরিবেশ ধ্বংস করা হয় এবং তার পেছনে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত থাকেন, তখন পরিবেশ সুরক্ষা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক লাভের লোভ পরিবেশের গুরুত্বকে ছাপিয়ে যায়। উচ্ছেদ অভিযান বা মামলা হলেও ক্ষমতার দাপটে অনেক সময় তা ফলপ্রসূ হয় না।

সোনাদিয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নাম উঠে আসাটা হতাশাজনক। কারণ পরিবেশ সুরক্ষা একটি জাতীয় ইস্যু এবং এর জন্য দলমত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। যখন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই পরিবেশ ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তখন সাধারণ মানুষ বা ছোটখাটো উদ্যোক্তাদের সচেতন করার প্রচেষ্টা কঠিন হয়ে পড়ে।

ভবিষ্যতের পথ: কঠোরতা ও সচেতনতা

সোনাদিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত এলাকাগুলোকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন:

  1. আইনের কঠোর প্রয়োগ: কেবল মামলা নয়, আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন কাজ করার সাহস না পায়।
  2. অবিরত তদারকি ও উচ্ছেদ: উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে এবং তা যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য নিয়মিত ও দীর্ঘমেয়াদী তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে।
  3. সমন্বিত প্রচেষ্টা: পরিবেশ বিষয়ক কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একযোগে কাজ করতে হবে।
  4. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় জনগণকে প্যারাবনের গুরুত্ব এবং পরিবেশ রক্ষায় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। একে বাঁচানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সুরক্ষা কবচকে ধ্বংস করা মানে নিজেদেরই বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া।

শেষ কথা

সোনাদিয়ার প্যারাবনে চিংড়িঘের তৈরি এবং তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ – এই ঘটনা প্রমাণ করে যে পরিবেশ ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি কতটা গভীরে পৌঁছেছে। যখন ক্ষমতার সঙ্গে লোভ যুক্ত হয়, তখন পরিবেশ সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়। জলবায়ু পরিবর্তন যখন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন সোনাদিয়ার মতো প্রাকৃতিক ঢালগুলোকে রক্ষা করাটা শুধু পরিবেশের জন্য নয়, আমাদের নিজেদের টিকে থাকার জন্যও অপরিহার্য।

সোনাদিয়ার এই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ এবং তার পেছনের কারণগুলো আমাদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে – আমরা কি সত্যিই আমাদের পরিবেশকে বাঁচাতে চাই, নাকি সাময়িক লাভের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত?

আপনার কী মনে হয়? সোনাদিয়ার মতো এলাকাগুলোকে বাঁচাতে এবং পরিবেশ ধ্বংসকারীদের রুখতে আর কী কী করা উচিত? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্যারাবন সুরক্ষার গুরুত্ব কতটা? কমেন্ট করে জানান আপনার মূল্যবান মতামত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ