যানজট, ধোঁয়া আর হর্ন – ঢাকার রাস্তা মানেই যেন এক সীমাহীন দুর্ভোগ। শহরের বাতাস দূষিত, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে আর কার্বন নিঃসরণ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই পরিচিত চিত্রের মধ্যেই এবার এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। রাজধানী ঢাকায় নামানো হতে পারে অত্যাধুনিক বিদ্যুৎ-চালিত বা ইলেকট্রিক বাস! আর এজন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে বিশাল এক প্রকল্পের, যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। ঢাকার রাস্তায় নামছে ইলেকট্রিক বাস
এই প্রকল্প যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় এটা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু কেন এই বিশাল বিনিয়োগ? ২৫০০ কোটি টাকা খরচ করে কেন বিদ্যুৎ-চালিত বাসের দিকে ঝুঁকছে কর্তৃপক্ষ? এর পেছনে কি কেবল যানজট বা সেবার মান উন্নয়নের চিন্তা, নাকি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো আরও বড় কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে?
২৫০০ কোটির পরিকল্পনা: কী থাকছে এই প্রকল্পে?
সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ থেকে এই বৈদ্যুতিক বাস প্রকল্পের একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। প্রস্তাব অনুযায়ী:
- বাসের সংখ্যা: প্রাথমিকভাবে ৪০০টি বিদ্যুৎ-চালিত বাস কেনা হবে।
- খরচ: এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় অংশ (প্রায় ২১৩৫ কোটি টাকা) আসবে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে এবং বাকি টাকা (৩৬৫ কোটি টাকা) দেবে বাংলাদেশ সরকার।
- বাস্তবায়নের সময়সীমা: প্রকল্পটি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে ২০৩০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলবে।
- পরিচালনার দায়িত্বে: এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব পালন করবে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।
- চলবে কোথায়? বাসগুলো প্রধানত ঢাকা শহর এবং পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জে চলাচল করবে।
- ডিপো ও চার্জিং স্টেশন: বৈদ্যুতিক বাসের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো চার্জিংয়ের ব্যবস্থা। প্রকল্পের আওতায় তিনটি জায়গায় ডিপো বা বাস রাখার স্থান নির্মাণ করা হবে, যেখানে থাকবে চার্জিং স্টেশন। প্রাথমিকভাবে পূর্বাচলে একটি, রাজউকের ঝিলমিল এলাকায় আরেকটি এবং কাঁচপুরে তৃতীয় ডিপোটি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
- পরিচালনা মডেল: বাসগুলো কোম্পানিভিত্তিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলের অধীনে অপারেটরদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনাটি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মূল্যায়ন কমিটির সভায় আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এই আলোচনা থেকেই প্রকল্পের ব্যয় এবং অন্যান্য বিস্তারিত বিষয় চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকার রাস্তায় নামছে ইলেকট্রিক বাস
কেন ইলেকট্রিক বাস? পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। প্রচলিত ডিজেল বা অকটেন চালিত বাসগুলো প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ করে, যা ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এই বায়ুদূষণ শহরের মানুষের স্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে। শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার পেছনে দূষিত বাতাসের বড় ভূমিকা রয়েছে।
অন্যদিকে, এই প্রচলিত বাসগুলো থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় – এসব আমাদের জীবন ও জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। ঢাকার রাস্তায় নামছে ইলেকট্রিক বাস
এখানেই আসে ইলেকট্রিক বাসের প্রয়োজনীয়তা:
- বায়ুদূষণ কম: ইলেকট্রিক বাসের কোনো সাইলেন্সার পাইপ থাকে না, তাই এটি চলার সময় কোনো ধোঁয়া বা বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ করে না। এর ফলে শহরের বাতাস অনেক বেশি পরিষ্কার থাকবে, যা সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করবে। এটি ঢাকার বায়ুর গুণগত মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
- কার্বন নিঃসরণ হ্রাস: জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে বিদ্যুৎ ব্যবহার করার কারণে ইলেকট্রিক বাস সরাসরি কার্বন নিঃসরণ করে না। যদি এই বাসগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি (যেমন সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎ) থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চার্জ করা হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে কার্বন ফুটপ্রিন্ট অনেক কমে আসবে। এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি পূরণে সহায়তা করবে।
- টেকসই নগর পরিবহন: ইলেকট্রিক বাস চালু করা টেকসই নগর পরিবহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি সাশ্রয়ীও হতে পারে।
- শব্দদূষণ কম: প্রচলিত বাসের চেয়ে ইলেকট্রিক বাস অনেক কম শব্দ করে চলে। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে শব্দদূষণ একটি বড় সমস্যা। ইলেকট্রিক বাস কিছুটা হলেও এই সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে পারে।
প্রকল্পের প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধান, পরিবহন খাত থেকে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং উন্নত মানের বৈদ্যুতিক বাস চালু করে গণপরিবহন আধুনিকায়ন করা এর অন্যতম লক্ষ্য। এটি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশদূষণ রোধ ও বায়ুমান উন্নয়ন, এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর মতো জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
শুধু পরিবেশ নয়, আরও অনেক সুবিধা
পরিবেশগত সুবিধার বাইরেও এই প্রকল্পের আরও কিছু লক্ষ্য রয়েছে:
- গণপরিবহনের সেবার মান উন্নয়ন: আধুনিক, আরামদায়ক ইলেকট্রিক বাস চালু হলে সাধারণ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত হবে, যা ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমাতে এবং যানজট নিরসনে সাহায্য করতে পারে।
- যানজট হ্রাস: উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা পরোক্ষভাবে যানজট কমাতেও ভূমিকা রাখে।
- প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি: এই প্রকল্পের মাধ্যমে ডিটিসিএ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থার ইলেকট্রিক পরিবহন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে সক্ষমতা বাড়বে।
- নীতিমালা প্রণয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন: ইলেকট্রিক বাসের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরি এবং চার্জিং স্টেশন ও ডিপোর মতো অবকাঠামো উন্নয়নেও কাজ করা হবে।
তবে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় এর আগেও সংস্কার আনার চেষ্টা হয়েছে, যেমন বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের মাধ্যমে চালু হওয়া নগর পরিবহন। সেটি পুরোপুরি সফল হয়নি। তাই ২৫০০ কোটি টাকার এই নতুন প্রকল্প কতটা সফল হবে, তা নিয়ে হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জরুরি সমস্যাগুলো মোকাবিলায় এই ধরনের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান খুবই প্রয়োজনীয়।
এক বড় পদক্ষেপ, এক নতুন আশা
রাজধানীতে বিদ্যুৎ-চালিত বাস চালু করার পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে এক বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি কেবল পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন নয়, এটি ঢাকার বাতাসকে পরিচ্ছন্ন করার, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার একটি প্রতীক। বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ সহায়তা এই প্রকল্পের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
২৫০০ কোটি টাকা একটি বড় অঙ্কের বিনিয়োগ। এর সঠিক ব্যবহার এবং প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাটা খুবই জরুরি। যদি এই ৪০০টি ইলেকট্রিক বাস সফলভাবে চালানো যায় এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হয়, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো আরও বড় পরিসরে এই ধরনের বাস চালু করা সম্ভব হবে।
এই প্রকল্প যদি সফল হয়, তাহলে ঢাকার রাস্তা হয়তো একদিন ধোঁয়ামুক্ত হবে, বাতাস হবে নিশ্বাস নেওয়ার যোগ্য এবং শহরের জীবনযাত্রা হবে আরও সুস্থ ও টেকসই। এটি শুধু ঢাকার জন্যই নয়, দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোর জন্যও হতে পারে একটি অনুসরণীয় উদাহরণ। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন যখন মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম, তখন এই ধরনের সাহসী এবং প্রযুক্তি নির্ভর পদক্ষেপগুলোই আমাদের ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগায়।
শেষ কথা
ঢাকায় ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইলেকট্রিক বাস চালুর পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে উত্তেজনাকর। এটি আমাদের পরিবেশকে বাঁচানোর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর একটি বড় সুযোগ। তবে কেবল পরিকল্পনা করলেই হবে না, এর সঠিক ও স্বচ্ছ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। এই বাসগুলো যেন সত্যিই ঢাকার বায়ুদূষণ কমায়, কার্বন নিঃসরণ রোধ করে এবং মানুষের যাতায়াতকে সহজ ও পরিবেশবান্ধব করে তোলে – সেটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।
ঢাকায় ইলেকট্রিক বাস চালুর এই পরিকল্পনা নিয়ে আপনার কী ভাবনা? ২৫০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প ঢাকার পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন? কমেন্ট করে জানান আপনার মূল্যবান মতামত।