32.8 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৫
spot_img

বন বিভাগের হাতে ফিরল সোনাদিয়া দ্বীপ: কেন জরুরি ছিল এই পদক্ষেপ?

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি। এখানে আছে পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর অসংখ্য দ্বীপ। কিন্তু এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনেকখানিই আজ হুমকির মুখে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। এমন এক পরিস্থিতিতে, কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ নিয়ে সম্প্রতি একটি খবর আমাদের মনে আশার আলো জাগিয়েছে। দীর্ঘ আট বছর হাতছাড়া থাকার পর, এই দ্বীপের বিশাল এক অংশ বন বিভাগের হাতে ফিরে আসছে। সরকার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) দেওয়া দ্বীপের ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল করেছে। এই ঘটনা কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি আমাদের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার লড়াইয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আসুন, আমরা এই পুরো ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে জেনে নিই এবং এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করি। কেন জরুরি ছিল এই পদক্ষেপ

সোনাদিয়া দ্বীপ: প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ

সোনাদিয়া কেবল একটি দ্বীপ নয়। এটি উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। এখানকার ম্যানগ্রোভ বন, বিশাল বালিয়াড়ি, অতিথি পাখির সমাগম এবং নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর বসবাস এটিকে করেছে অনন্য। এই দ্বীপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উপকূলীয় ঢাল হিসেবেও কাজ করে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস – এমন সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা কমাতে ম্যানগ্রোভ বন এবং দ্বীপের পরিবেশ একটি সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করে। তাই সোনাদিয়ার পরিবেশের সুরক্ষা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত জরুরি। কেন জরুরি ছিল এই পদক্ষেপ

আট বছরের বন্দোবস্ত বাতিল: কেন এই সিদ্ধান্ত?

খবর অনুযায়ী, সরকার বেজাকে সোনাদিয়া দ্বীপের প্রায় ৯ হাজার ৪৬৭ একর ভূমি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য বন্দোবস্ত দিয়েছিল। এই বন্দোবস্তের কেস নম্বর ছিল ৫/২০১৬। এই বিশাল ভূমির মধ্যে ছিল সোনাদিয়া মৌজার ২ হাজার ৭১২ একর, প্রস্তাবিত সমুদ্র বিলাস মৌজার ৪ হাজার ৮৩৯ একর এবং প্রস্তাবিত চর মকবুল মৌজার ১ হাজার ৯১৮ একর ভূমি। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার একর জমি, যা ২০১৭ সালে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক তৈরির শর্তে বেজাকে নামমাত্র ১ হাজার ১ টাকা সেলামিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু সমস্যাটা শুরু হলো এখানেই। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ইকো-ট্যুরিজম পার্কের নামে জমি পাওয়ার পর সোনাদিয়া দ্বীপে এমন কিছু কাজ হয়েছে যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। গাছ কাটা, চিংড়ির ঘের নির্মাণসহ বিভিন্ন পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এর ফলে দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ইকো-ট্যুরিজমের উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশ রক্ষা করে পর্যটন গড়ে তোলা, কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টোটা। প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ ধ্বংসের মুখে পড়ে।

ঠিক এই কারণেই সরকার বেজাকে দেওয়া এই বন্দোবস্ত বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের খাসজমি-২ শাখার উপসচিব মাসুদ কামাল গত ৫ মে এ নিয়ে একটি স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন, যা বন্দোবস্ত বাতিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। আট বছর পর বন বিভাগ তাদের এই বিশাল ভূমি ফিরে পাচ্ছে, যা সোনাদিয়ার ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এই বন্দোবস্ত বাতিল আসলে পরিবেশ রক্ষার এক স্পষ্ট বার্তা। কেন জরুরি ছিল এই পদক্ষেপ

আইনি লড়াই ও পরিবেশ সচেতনতা

এই সিদ্ধান্তের পেছনে পরিবেশ সচেতন নাগরিকদের ভূমিকাও কম নয়। যখন বেজা সোনাদিয়া দ্বীপে দেশের বৃহত্তম ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ার পরিকল্পনা হাতে নেয় এবং ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু করে, তখনই পরিবেশবাদীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুযায়ী রিট দায়ের করে। তাদের যুক্তি ছিল, ইকো-ট্যুরিজম পার্ক করা হলেও দ্বীপের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা দরকার। এই রিটের ফলেই জমির বরাদ্দ স্থগিত করে দেয় হাইকোর্ট।

এই আইনি লড়াই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পরিবেশ রক্ষার জন্য নাগরিক সচেতনতা এবং সক্রিয় পদক্ষেপ কতটা জরুরি। বেলার মতো সংগঠনগুলোর কারণে সোনাদিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হয়তো রক্ষা পেতে চলেছে। সরকার পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে এই ক্ষতি পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, যা ইতিবাচক।

বন বিভাগের হাতে ফেরা: পুনরুদ্ধারের মহাপরিকল্পনা?

ভূমি ফিরে পাওয়ার পর বন বিভাগ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে। এগুলো হলো:

  1. অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ: যারা অবৈধভাবে দ্বীপের জমি দখল করে পরিবেশের ক্ষতি করছিল, তাদের উচ্ছেদ করে জমি দখলমুক্ত করা হবে। এটি পুনরুদ্ধারের প্রথম এবং জরুরি পদক্ষেপ।
  2. খালের মুখ ও শাখা-প্রশাখার বাঁধ অপসারণ: দ্বীপের ভেতরের ছোট ছোট খাল বা চ্যানেলে বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহ বন্ধ করে চিংড়ির ঘের বা অন্য কিছু করা হচ্ছিল। এই বাঁধগুলো অপসারণ করে জোয়ারের পানি প্রবাহ আবার সুগম করা হবে। এটি ম্যানগ্রোভ বনসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
  3. বালিয়াড়ি পুনরুদ্ধার ও সৈকত সংরক্ষণ: সোনাদিয়ার বালিয়াড়িগুলো উপকূলীয় সুরক্ষার অন্যতম অংশ। এগুলো পুনরুদ্ধার এবং সৈকতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজ করা হবে।
  4. ম্যানগ্রোভ ও নন-ম্যানগ্রোভ গাছের চারা রোপণ: কেওড়া, কেয়া, নিশিন্দা, নারকেল, তালগাছ সহ বিভিন্ন ধরণের ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় গাছের চারা রোপণ করা হবে। এটি দ্বীপের সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে এবং জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। ম্যানগ্রোভ বন উপকূলকে ভাঙন থেকে রক্ষা করে এবং অনেক সামুদ্রিক প্রাণীর আশ্রয়স্থল।
  5. দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ: দ্বীপের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে কেবল তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নয়, একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও নেওয়া হবে। এই পরিকল্পনা পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে টেকসই সমাধান দেবে বলে আশা করা যায়।

এই পদক্ষেপগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে সোনাদিয়া দ্বীপ ধীরে ধীরে তার হারানো সৌন্দর্য এবং প্রাণ ফিরে পাবে। বন বিভাগের এই পরিকল্পনা সোনাদিয়াকে একটি সংরক্ষিত এবং নিরাপদ স্থানে পরিণত করার পথ খুলে দিয়েছে।

সোনাদিয়া: রক্ষিত এলাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াই

এই পুরো ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সোনাদিয়া দ্বীপকে এখন ‘রক্ষিত এলাকা’ (Protected Area) ঘোষণা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই ৯ হাজার ৪৬৭ একর বনভূমিকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে গত ১৭ মার্চ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। রক্ষিত এলাকা ঘোষণার অর্থ হলো, সেখানে পরিবেশ বিধ্বংসী যেকোনো কার্যক্রম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকবে এবং প্রকৃতির সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল অত্যন্ত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং জলোচ্ছ্বাস এখনকার বাস্তবতা। সোনাদিয়ার মতো দ্বীপ এবং এর ম্যানগ্রোভ বন এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। একটি সুস্থ ও শক্তিশালী উপকূলীয় পরিবেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। সোনাদিয়াকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা এবং এর পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা তাই কেবল দ্বীপটির জন্যই নয়, পুরো উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্যও অপরিহার্য।

বেজার পরিচালক (বিনিয়োগ উন্নয়ন ও মনিটরিং) শাহীন আক্তার সুমি জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, বেজাও সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ভূমির দখল বন বিভাগকে বুঝিয়ে দিতে প্রস্তুত। এটি একটি ইতিবাচক দিক।

শেষ কথা: আমাদের প্রত্যাশা এবং দায়িত্ব

সোনাদিয়া দ্বীপের বন্দোবস্ত বাতিল এবং বন বিভাগের হাতে তার ফিরে আসা পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা। এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক সময়ে সচেতনতা এবং পদক্ষেপ নিলে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। এই দ্বীপের পুনরুদ্ধার কেবল গাছ লাগানো বা দখলদার উচ্ছেদ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। এটি হওয়া উচিত একটি সামগ্রিক প্রচেষ্টা, যেখানে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে এবং দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রকে তার নিজস্ব ছন্দে ফিরতে দেওয়া হবে।

আমরা আশা করি, বন বিভাগ এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয় তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবে এবং সোনাদিয়া দ্বীপ আবারও তার আগের রূপে ফিরে আসবে – যেখানে থাকবে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, সুরক্ষিত উপকূল এবং প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য। এই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, উন্নয়নের নামে যেন আমরা আমাদের পরিবেশকে ধ্বংস না করি। পরিবেশকে সুরক্ষিত রেখেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।

সোনাদিয়ার এই গল্প আমাদের শেখায় যে, আমাদের প্রকৃতি বিপদে পড়লে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এটিকে সফল করতে হলে প্রয়োজন ধারাবাহিক তদারকি এবং সকলের সহযোগিতা। আসুন, আমরা সোনাদিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো রক্ষার জন্য আওয়াজ তুলি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করি।

এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে। পরিবেশ রক্ষায় আপনার আগ্রহই এই ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনকে সম্ভব করে তোলে। তাই পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করুন, অন্যদের জানান এবং প্রকৃতি সুরক্ষায় যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখুন। মনে রাখবেন, সুস্থ পরিবেশ মানেই সুস্থ ভবিষ্যৎ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ