বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে আছে সারা দেশে, যা আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার মধ্য দিয়েও বয়ে গেছে খরস্রোতা তিস্তাসহ নাউতারা, বুড়িতিস্তা, শিঙ্গাহারা, কামনাই ও ধুমের মতো ছোট ছোট অনেক নদী। একসময় হয়তো এই নদীগুলো ছিল প্রাণবন্ত, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। কিন্তু আজ? আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দখল আর দূষণের থাবায় এই নদীগুলো আজ মুমূর্ষুপ্রায়, আর এদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে। আসুন, আমরা ডিমলার নদীগুলোর এই করুণ দশা এবং এর পেছনের কারণগুলো বিস্তারিতভাবে জেনে নিই। দখল-দূষণে মুমূর্ষু ডিমলার নদীগুলো
হারিয়ে যাচ্ছে নদীর প্রাণ: দখল আর দূষণের থাবা
ডিমলার নাউতারা, বুড়িতিস্তা, শিঙ্গাহারা, কামনাই ও ধুম – এক সময়ের এই খরস্রোতা নদীগুলো দিনের পর দিন তাদের রূপ হারাচ্ছে। কারা এর জন্য দায়ী? স্থানীয়দের অভিযোগ এবং বাস্তবতা বলছে, এর প্রধান কারণ হলো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অবৈধ দখল। নদীপথ সংকুচিত করে, পাড় দখল করে নির্মাণ হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা বা কৃষিজমি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
নদী দখলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে, যা নদীর পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে। দখল আর দূষণের এই দ্বিমুখী আক্রমণে নদীগুলো কেবল সরু হয়ে যাচ্ছে না, এদের পানি ব্যবহারেরও অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, যা পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আর এর সরাসরি ফল ভোগ করছে নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য – মাছের প্রজাতি কমে যাচ্ছে, জলজ উদ্ভিদ নষ্ট হচ্ছে, অনেক প্রাণী তাদের আশ্রয় হারাচ্ছে। নদীগুলো এভাবে নিশ্চিহ্ন হতে বসার কারণে ব্যাহত হচ্ছে নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রাও। দখল-দূষণে মুমূর্ষু ডিমলার নদীগুলো
আশার আলো নিভে গেল: ব্যর্থ এক খনন প্রকল্পের গল্প
নদী বাঁচানোর জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তা নয়। প্রায় তিন বছর আগে নাউতারা ও ধুম নদীকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটি খনন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন সরকার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সারাদেশে ছোট নদ-নদী, খাল ও জলাশয় খনন করে পানি সংরক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি বড় প্রকল্প নিয়েছিল। সেই প্রকল্পের অধীনে, ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নাউতারা ও ধুম নদীর ৪০ কিলোমিটার খনন করে। কাজ সম্পন্ন হয় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে।
কিন্তু এই উদ্যোগের ফল ছিল হতাশাজনক। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই খননকাজ ছিল অদূরদর্শী এবং অপরিকল্পিত। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নদী থেকে খনন করে তোলা বালু বা মাটি নদীর পাড়েই স্তূপ করে রেখে দেয়। বর্ষার সময় যখন বৃষ্টি আসে, সেই স্তূপ করা বালু পানির তোড়ে ধসে আবার নদীর গর্ভেই ফিরে যায়! ফলে কী হলো? খনন শেষ হতে না হতেই নদীর তলদেশ আবার ভরাট হয়ে গেল। নদীগুলোর নাব্যতা ফিরে পাওয়ার বদলে উল্টো নাব্যতা হারিয়ে ছোট ছোট চরে পরিণত হলো।
১২ কোটি টাকা ব্যয়ে খনন হলো, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। এই অর্থ এবং শ্রম দুটোই যেন পানিতে গেল। এলাকাবাসী তাই এই খননকাজের মান এবং পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ব্যর্থতার ফল: দখলদারদের উল্লাস, প্রকৃতির কান্না
নদী খননের ব্যর্থতার করুণ পরিণতি হলো – নদীগুলো যখন চরে পরিণত হলো, তখন সেই সুযোগ কাজে লাগালো স্থানীয় প্রভাবশালী অবৈধ দখলদাররা। তারা নতুন জেগে ওঠা চরে ধানসহ বিভিন্ন রকমের সবজি চাষ শুরু করল। একদিকে যেমন নদীপথ দখল করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে দেওয়া হচ্ছিল, তেমনি অন্যদিকে নদীর ভেতর জেগে ওঠা চরেও শুরু হলো চাষাবাদ। দখল-দূষণে মুমূর্ষু ডিমলার নদীগুলো
এর ফলে যা হলো, তা পরিবেশের জন্য আরও ভয়ংকর। নদীর গতিপথ আরও বেশি পরিবর্তিত হয়ে গেল। নদীর বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) পুরোপুরি নষ্ট হতে শুরু করল। যে জীববৈচিত্র্য এমনিতেই দখল আর দূষণে হুমকির মুখে ছিল, এই চরাঞ্চল তৈরি এবং সেখানে চাষাবাদের ফলে তাদের টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়ল। নদী আর তার স্বাভাবিক রূপে নেই, নেই তার সেই প্রাণবন্ত জলপ্রবাহ। এটি কেবল ডিমলার নদীগুলোর জন্যই নয়, এটি সমগ্র পরিবেশের জন্যই একটি বড় আঘাত।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য: মাটির ধরন নাকি পরিকল্পনার অভাব?
এই অপরিকল্পিত খনন এবং দ্রুত ভরাট হয়ে যাওয়া নিয়ে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরীর একটি ব্যাখ্যা আছে। তিনি বলেছেন, এই অঞ্চলের মাটির ধরনের কারণেই নদী খননের পর সমস্যা হচ্ছে। তার মতে, নদীগুলোতে বালুর পরিমাণ বেশি, তাই খননের পরপরই আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
মাটির প্রকৃতি একটি কারণ হতেই পারে, কিন্তু প্রশ্ন হলো – ১২ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আগে কি সেই অঞ্চলের মাটির ধরন নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা বা পরিকল্পনা করা হয়নি? যদি মাটির ধরনের কারণে দ্রুত ভরাট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে খননের পর উত্তোলিত বালু বা মাটি সরানোর জন্য কি আরও টেকসই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল না? স্থানীয়দের অভিযোগ এবং নদীর বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয়, হয়তো পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে কোথাও বড় ধরনের গলদ ছিল।
পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট
ডিমলার এই নদীগুলোর করুণ দশা কেবল একটি স্থানীয় সমস্যা নয়। এটি বাংলাদেশের নদীগুলোর সামগ্রিক অবস্থারই একটি প্রতিচ্ছবি। দখল, দূষণ এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন সারা দেশের নদীকেই বিপন্ন করছে। আর এই নদীর মৃত্যু মানে কেবল পানির অভাব নয়, এটি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
সুস্থ নদী তার আশপাশের পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখে, মাটির উর্বরতা ধরে রাখে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক রাখে এবং অসংখ্য জীবের আশ্রয়স্থল হয়। যখন নদী মরে যায়, তখন পুরো পরিবেশটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যখন আমরা বন্যা, খরা, এবং অসময়ের বৃষ্টিপাতের মতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছি, তখন সুস্থ নদীগুলো প্রাকৃতিক সুরক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারত। কিন্তু নদীগুলোই যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের পরিবেশগত ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
ডিমলার জীববৈচিত্র্যের ওপর এই নদী সংকটের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মাছ, উভচর প্রাণী, পাখি, জলজ উদ্ভিদ – এই সবকিছুর টিকে থাকা নদীর স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। নদী মরে গেলে এই জীবগুলোও হারিয়ে যাবে, যা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে আরও দরিদ্র করবে।
শেষ কথা: নদী বাঁচানো কেন জরুরি, আর আমাদের করণীয় কী?
ডিমলার নাউতারা, ধুম বা অন্য নদীগুলোর গল্প কেবল সেই অঞ্চলের মানুষের জন্য নয়, এটি আমাদের সবার জন্য একটি সতর্কবার্তা। নদীগুলো আমাদের জীবনরেখা, আমাদের পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের বাঁচানো মানে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ বাঁচানো।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে কঠোর হাতে, দূষণ বন্ধ করতে হবে। এবং নদী খননের মতো পুনরুদ্ধারের উদ্যোগগুলো হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত এবং টেকসই পরিকল্পনার ভিত্তিতে, যাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে যেন আবার ব্যর্থতার গল্প তৈরি না হয়।
আমাদের প্রত্যেকেরও কিছু দায়িত্ব আছে। পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হওয়া, নদী বা জলাশয়ে বর্জ্য না ফেলা এবং নদী দখল বা দূষণের মতো ঘটনা দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। আর সবচেয়ে বড় কথা, নদী এবং পরিবেশ সুরক্ষায় যারা কাজ করছেন, তাদের পাশে দাঁড়ানো।
ডিমলার নদীগুলোর কান্না হয়তো আমাদের শুনতে হবে। এই কান্না থামানোর দায়িত্ব আমাদেরই। একটি সুস্থ পরিবেশ মানেই সুস্থ জীবন। নদী বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, আর প্রকৃতি বাঁচলে আমরা বাঁচব। আসুন, পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের যুক্ত করি, সচেতনতা বৃদ্ধি করি এবং ডিমলার নদীগুলোর মতো বিপন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ পুনরুদ্ধারে সোচ্চার হই। আপনার ছোট একটি পদক্ষেপও হয়তো এই বিশাল উদ্যোগে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষায় বিনিয়োগ মানে আপনার নিজের ভবিষ্যতের সুরক্ষায় বিনিয়োগ।
এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে এবং নদী বাঁচাতে আপনার করণীয় সম্পর্কে আরও জানতে আমাদের সাথেই থাকুন। এই পোস্টটি শেয়ার করে অন্যদেরও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে জানান।