আমরা বাংলাদেশিরা নদীর সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধনে বাঁধা। নদী আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, আমাদের পরিবেশের ধারক ও বাহক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের অনেক নদ-নদী আজ মৃতপ্রায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা এবং উজানের বিভিন্ন কার্যক্রমে আমাদের নদীগুলো তাদের প্রাণ হারাচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে, একটি নদী আমাদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে – সেটি হলো ব্রহ্মপুত্র নদ। এটি কেবল একটি বিশাল জলধারা নয়, এই মুহূর্তে এটি বাংলাদেশের প্রাণের প্রতীক। কেন ব্রহ্মপুত্র আমাদের জন্য এত জরুরি এবং কেন এখনই আমাদের এটিকে বাঁচানোর জন্য কাজ করতে হবে, আসুন তা জেনে নিই। ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের প্রাণ
নদী যখন মৃতপ্রায়: ব্রহ্মপুত্র কেন ব্যতিক্রম?
নদী গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা না করার কারণে এবং বিশেষ করে আন্তসীমান্ত নদীগুলোতে উজানের দেশ কর্তৃক বাঁধ দেওয়ার ফলে পানির অভাবে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। অনেক নদী তার স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়েছে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির মুখে।
এই প্রেক্ষাপটে, ব্রহ্মপুত্র নদের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি এমন একটি নদ যা বাংলাদেশের পানি সরবরাহের প্রায় ৬৭ শতাংশ বহন করে নিয়ে আসে। নদী গবেষক শেখ রোকন সম্প্রতি একটি ‘ব্রহ্মপুত্র কনভেনশনে’ বলেছেন যে, এই মুহূর্তে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের জন্য ‘প্রাণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, অন্য অনেক আন্তসীমান্ত নদীর উজানে বাঁধ থাকলেও ব্রহ্মপুত্রের উজানে (ভারতে) এখনো সেভাবে কোনো বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি যা এর পানি প্রবাহকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। আর ঠিক এই কারণেই আমাদের ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচানো এখন আরও বেশি জরুরি। ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের প্রাণ
ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ: অপরিকল্পনা ও আগ্রাসন
তবে ব্রহ্মপুত্রও সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। বিভিন্ন আলোচনা এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রহ্মপুত্রও বেশ কিছু গুরুতর হুমকির মুখে পড়েছে:
- উজানে পানি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা: ব্রহ্মপুত্র একটি আন্তর্জাতিক নদ। শেখ রোকন উল্লেখ করেছেন যে, আন্তনদী সংযোগের নামে ভারত ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে একতরফা পানি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের জন্য এটি হবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়।
- অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও নদী শাসন: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা নদীর গতি বা প্রকৃতিকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। বছরের পর বছর ধরে জিও ব্যাগ ফেলে নদীভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা বা অপরিকল্পিতভাবে নদীকে ‘শাসন’ করার চেষ্টা আসলে নদীকেই মেরে ফেলছে।
- অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন: ব্রহ্মপুত্র নদের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এটি নদীর পাড়ে ভাঙন বাড়াচ্ছে এবং নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলছে, যা দীর্ঘমেয়াদে নদের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
এই সব কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের স্বাস্থ্য আজ সংকটাপন্ন। যদি এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তাহলে তিস্তার চরের মতো আরও অনেক জায়গায় কৃষকের স্বপ্ন ডুববে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে এবং আমাদের পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কেন আমাদের ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচাতে হবে?
ব্রহ্মপুত্র কেবল পানি সরবরাহ করে না। এটি আমাদের কৃষি, পরিবহন, মৎস্য সম্পদ এবং পরিবেশের জন্য অপরিহার্য। কমরেড রাজেকুজ্জামান এক কনভেনশনে বলেছেন, “আমরা নদীকে শুধু শাসন করতে চাই… ব্রহ্মপুত্র নদ এ অঞ্চলের কারও শত্রু নয়। মানুষকে বাঁচানোর জন্য ব্রহ্মপুত্র নদকে বাঁচাতে হবে।” এই কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচানো মানে কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা নয়, এটি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করা, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিশ্চিত করা। ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের প্রাণ
করণীয়: সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি
বিশেষজ্ঞরা ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন:
- নদী ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যা নদীর প্রাকৃতিক গতিপ্রকৃতিকে সম্মান করবে।
- নদীতে ক্ষতিকর হস্তক্ষেপ (যেমন অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, অপরিকল্পিত বাঁধ বা জিও ব্যাগ ব্যবহার) বন্ধ করা।
- প্রয়োজনে উজানের দেশ ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে যৌথভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ বাঁচানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
- নদী দখল ও দূষণ রোধে কঠোর হওয়া এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
শেষ কথা: জীবনরেখাকে বাঁচানোর যুদ্ধ
ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের প্রাণ। এটি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। তিস্তার চরের ঘটনা একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র, যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণ কতটা বিধ্বংসী হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে আমাদের ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের প্রাণ, এবং এই প্রাণকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
নদী বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষিত থাকবে, আমাদের পরিবেশ সুস্থ থাকবে এবং আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী হব। আসুন, আমরা পরিবেশ রক্ষায় আরও বেশি সচেতন হই, নদী বাঁচাতে সোচ্চার হই এবং এই জীবনরেখাকে বাঁচাতে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখি। পরিবেশ সুরক্ষায় বিনিয়োগ মানে আপনার নিজের এবং আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষায় বিনিয়োগ।
এই বিষয়ে আরও জানতে এবং পরিবেশ রক্ষায় আপনার করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় অংশ নিতে আমাদের সাথেই থাকুন। আপনার মতামত নিচে কমেন্ট করে জানান এবং এই পোস্টটি শেয়ার করে অন্যদেরও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে জানান। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে আমাদের নদ-নদীগুলোকে বাঁচাতে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে।