বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো আমাদের প্রাণ। কিন্তু সেই প্রাণধারাই যখন বিষাক্ত হয়ে ওঠে, তখন তা শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, আমাদের সবার অস্তিত্বের জন্যই বড় হুমকি। সম্প্রতি চাঁদপুরের একটি অংশে মেঘনা নদীতে মরা মাছ ও জলজ প্রাণী ভেসে ওঠার ঘটনা সেই ভয়াবহ চিত্রই তুলে ধরেছে। যদিও এখন মরা মাছের পরিমাণ কমেছে, কিন্তু পানি এখনো স্বাভাবিক হয়নি, আর তদন্তে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য। মেঘনায় পানি এখনো বিষাক্ত
চাঁদপুরের একটি দীর্ঘ এলাকা জুড়ে মেঘনা নদীতে হঠাৎ করেই বিপুল সংখ্যক মরা মাছ ও জলজ প্রাণী ভেসে উঠতে শুরু করেছিল কয়েক দিন আগে। লাল চেউয়া, সাদা চেউয়া, বেলে, সেলেং, চাপিলা, চিংড়ি, কাঁচকি, এমনকি জাটকা পর্যন্ত মরে ভেসে উঠছিল। নদীর তীরে মরা মাছের স্তূপ জমে গিয়েছিল, যা থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। এই দৃশ্য স্থানীয়দের মনে চরম উদ্বেগ তৈরি করেছিল। মেঘনায় পানি এখনো বিষাক্ত
দৃশ্যমান পরিবর্তন, কিন্তু আসল ছবি কী?
বর্তমানে নদীর পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি এবং জোয়ারের পানির কারণে তীরে জমে থাকা মরা মাছ ও জলজ প্রাণী অনেকটাই নদীতে ভেসে গেছে। ফলে নদীর তীর এখন আগের চেয়ে ছিমছাম এবং দুর্গন্ধ কিছুটা কমেছে। নদীর পানিতে ভেসে ওঠা মরা মাছও তেমন দেখা যাচ্ছে না, যা আছে তা আকারে খুব ছোট।
কিন্তু এই আপাত উন্নতি কি সমস্যার সমাধান? সরেজমিনে দেখা গেছে, মেঘনার পানির স্বাভাবিক সবুজ বা মিঠাপানির রং এখনো ফেরেনি। পানি এখনো ঘোলাটে ও কালচে রয়ে গেছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই পানি এখনো গোসল বা ধোয়ামোছার জন্য ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এটিই প্রমাণ করে যে, মরা মাছ ভেসে যাওয়া মানেই দূষণ চলে যাওয়া নয়, বরং দূষণ এখনো বিদ্যমান।
তদন্ত কমিটি কী খুঁজে পেয়েছে?
গত আগস্ট মাসেও একবার মেঘনায় এ ধরনের মরা মাছ ভেসে ওঠার ঘটনা ঘটেছিল। তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই তদন্ত কমিটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বা পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তদন্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মেঘনার পানির দূষণমাত্রার সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ওই এলাকার মেঘনার পানিতে অক্সিজেন এবং পিএইচের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। এর পাশাপাশি, পানিতে অ্যামোনিয়ার মাত্রা অনেক বেশি থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পানির অক্সিজেন কমে গেলে জলজ প্রাণীদের শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। পিএইচ মাত্রা অস্বাভাবিক হলে তা পানির গুণাগুণ নষ্ট করে এবং জীবের জন্য ক্ষতিকর হয়। আর অ্যামোনিয়া একটি বিষাক্ত গ্যাস, যা পানিতে মিশে জলজ প্রাণীদের মেরে ফেলতে পারে। এই তিনটি কারণই মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
দূষণের উৎস কোথায়? বিশেষজ্ঞদের ধারণা
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই দূষণের প্রধান উৎস হলো ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য। এই বর্জ্য বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে জোয়ারের স্রোতে মেঘনার সবুজ মিঠাপানিতে মিশে যাচ্ছে। এটিই মেঘনার পানিকে দূষিত করে তুলছে এবং অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, যার ফলস্বরূপ ব্যাপক হারে মাছ ও জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। এটি স্পষ্টতই উজানের দূষণ, যা ভাটির নদী ও পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশের অবক্ষয় এবং মেঘনার কান্না
মেঘনার এই পরিস্থিতি কেবল স্থানীয় দূষণের ঘটনা নয়, এটি বৃহত্তর পরিবেশগত অবক্ষয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথেও সম্পর্কিত হতে পারে।
- নদীর প্রবাহে পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন এবং নদীর প্রবাহে অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেলে বা বর্ষায় হঠাৎ বেশি পানি এলে দূষণের মাত্রা আরও মারাত্মক হতে পারে।
- বাস্তুতন্ত্রের নাজুকতা: দূষণ নদীর বাস্তুতন্ত্রকে দুর্বল করে তোলে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অতিরিক্ত চাপ তখন এই নাজুক বাস্তুতন্ত্রের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে ওঠে। মাছ এবং অন্যান্য জীবজন্তু পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না যখন তাদের আবাসস্থলই বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
- কৃষি ও জীবিকার ঝুঁকি: মেঘনার দূষিত পানি কেবল মাছ মারে না, তা কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত হলে মাটি ও ফসলের ক্ষতি করতে পারে। নদীর উপর নির্ভরশীল জেলে বা স্থানীয়দের জীবিকা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যারা এমনিতেই ঝুঁকিতে আছেন (যেমন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ), তাদের জন্য এটি আরও বড় সমস্যা তৈরি করে।
মেঘনার সবুজ পানি কালচে হয়ে যাওয়া এবং জলজ প্রাণী মারা যাওয়া আমাদের পরিবেশের স্বাস্থ্যের এক চরম অবনতিকে নির্দেশ করে। এটি এক ধরণের নীরব কান্না, যা আমাদের শোনা উচিত।
প্রকৃতির এই আর্তনাদ কি শুনতে পাচ্ছেন? পরিবেশ রক্ষায় আপনার ভূমিকা কী?
মেঘনার এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো কতটা বিপন্ন। কলকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করা, নদীর আশেপাশে অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং দূষণ রোধে উদাসীনতা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে চরম ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
১. দূষণ রোধে চাপ: শিল্পবর্জ্য পরিশোধন না করে নদীতে ফেলা বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও শিল্প মালিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি। পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
২. নদী পরিষ্কার অভিযান: স্থানীয়ভাবে বা সরকারি উদ্যোগে নদী পরিষ্কার এবং দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি: নদী দূষণের ভয়াবহতা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. পরিবেশ-বান্ধব পছন্দ: পরিবেশের উপর কম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এমন পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। এমন ব্যবসা বা উদ্যোগকে সমর্থন করুন যারা পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে। আপনার কেনাকাটার সিদ্ধান্তও পরিবেশের পক্ষে একটি ভোট। মেঘনায় পানি এখনো বিষাক্ত
৫. সহযোগিতা ও সমর্থন: যারা নদী রক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ বা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করে এমন বিশ্বস্ত সংস্থাগুলোকে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক বা নৈতিক সমর্থন দিন। তাদের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া মানেই আমাদের পরিবেশ রক্ষায় বিনিয়োগ করা।
মেঘনার মরা মাছ হয়তো জোয়ারের টানে ভেসে গেছে, কিন্তু পানি এখনো বিষাক্ত। এই বিষ আমাদের পরিবেশের জন্য চরম হুমকি। প্রকৃতির এই নীরব আর্তনাদকে উপেক্ষা না করে আসুন আমরা সবাই মিলে নদীকে বাঁচানোর এবং পরিবেশকে সুস্থ রাখার লড়াইয়ে শামিল হই। এটি কেবল প্রকৃতির জন্য নয়, আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
মেঘনার এই পানি দূষণ সম্পর্কে আপনার মতামত কী? নদী বাঁচাতে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? নিচে কমেন্ট করে আপনার মূল্যবান পরামর্শ জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অন্যদের সাথে শেয়ার করুন!