বাংলাদেশের পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, কক্সবাজারের চকরিয়ার সংরক্ষিত বনভূমি থেকে আসছে এক উদ্বেগজনক খবর। ইজারার আড়ালে বালু উত্তোলনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার গর্জন বনসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। এই ঘটনা শুধু বনভূমি ধ্বংসই নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের লড়াইকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। বিলীন হচ্ছে হাতিদের পথ
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কাছাকাছি অবস্থিত মধুশিয়া গর্জন বন দূর থেকে দেখতে আকর্ষণীয় হলেও, কাছে গেলে ধরা পড়ে এর জীর্ণ দশা। গাছের গোড়া থেকে মাটি সরে গেছে, মনে হচ্ছে যেন যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়বে বিশাল সব গর্জন গাছ। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই দুরবস্থার প্রধান কারণ হলো একটি খালের বালু উত্তোলন। বিলীন হচ্ছে হাতিদের পথ
কী ঘটছে আসলে?
খুটাখালি খাল নামের এই জলধারাটি সংরক্ষিত বনভূমির পাশে অবস্থিত। স্থানীয়দের মতে, বালু উত্তোলনে জড়িত একটি চক্র বা সিন্ডিকেট ইজারা নিয়ে এই কাজ করছে। কিন্তু তাদের অভিযোগ, তারা কেবল খালের ভেতরের বালুই নয়, বরং বনের সীমানায় ঢুকে সংরক্ষিত বনভূমি থেকেও অবৈধভাবে বালু তুলছে। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে বালু তোলায় খালের দুই পাশে থাকা বনভূমি ভেঙে খালের সঙ্গে মিশে গেছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, এখন উত্তোলন করার মতো বালু খুব বেশি অবশিষ্ট নেই, তবুও খনন চলছে।
আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বা রক্ষিত বনভূমির সর্বনিম্ন এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বালু বা মাটি উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ অভিযোগ উঠেছে, ইজারার নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে বনভূমির ভেতর থেকে বালু তোলা হচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ের চিত্র এবং প্রমাণ
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বালু তোলার জন্য ড্রেজার বসানো হয়েছে। খালটির বিভিন্ন অংশ ইজারা দেওয়া হলেও, ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে প্রতিটি অংশে সীমানার বাইরে গিয়ে বন থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বন্য হাতির মলের স্তূপ প্রমাণ করে যে, এই বন এশিয়ান বন্য হাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচরণ ক্ষেত্র। নির্বিচার বালু উত্তোলন শুধু গাছপালা ধ্বংস করছে না, বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থলও কেড়ে নিচ্ছে এবং তাদের চলাচলের পথ রুদ্ধ করছে। বিলীন হচ্ছে হাতিদের পথ
বিশেষজ্ঞ ও কর্তৃপক্ষের মতামত
একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন গবেষক যিনি এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, তিনি জানিয়েছেন যে, তিনি বছর কয়েক আগেই মধুশিয়া বন উজাড় হতে দেখেছেন বালু উত্তোলনের কারণে। তার মতে, এর পেছনে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী চক্র জড়িত। ইজারা যেন তাদের কাছে একটি সনদ মাত্র, যার আড়ালে তারা আশপাশের পাহাড় এবং বন থেকে মাটি ও বালু উত্তোলন করে। যেহেতু এখানকার বালু লবণাক্ত নয় এবং স্বাদু পানির উৎস থেকে আসে, তাই এর দাম বেশি এবং অবৈধ উত্তোলনকারীরা তাই খুবই বেপরোয়া। ঐ গবেষক আরও বলেন, বন টিকে থাকে মাটির উপর নির্ভর করে। মাটি সরে গেলে গাছপালা জন্মাবে না এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হবে। এটি কেবল গাছপালা নয়, এ অঞ্চলের বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে হাতিদের জন্যও বড় হুমকি। সামান্য রাজস্বের জন্য এত বড় পরিবেশগত ক্ষতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বন বিভাগের উদ্বেগ ও আইনি পদক্ষেপ
বন বিভাগ এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত ১৮ মার্চ বন বিভাগের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনকে একটি চিঠি দিয়ে খুটাখালি খাল ইজারা না দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বালু উত্তোলনের কারণে মধুশিয়া গর্জন বন, পাহাড় এবং বিভিন্ন সময়ে করা বনায়ন ধসে পড়ছে। ইজারার সীমানার বাইরে গিয়ে সংরক্ষিত ও রক্ষিত বন থেকে বালু তোলায় হাতি, শজারু, বন্য শূকর, বনবিড়াল, গন্ধগোকুল, হরিণ, শেয়ালসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। নির্বিচার বালু উত্তোলনের ফলে খালের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে বনের সীমানায় ঢুকে গেছে। এটি বিপন্ন এশিয়ান বন্য হাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচরণ ক্ষেত্র হওয়ায় ইজারা দেওয়া হলে বন, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য এবং সামগ্রিক পরিবেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
এর আগেও ২০২২ সালে পরিবেশবাদী একটি সংগঠনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই খালের ইজারা স্থগিত করেছিল। এর ফলে টানা তিন বছর ইজারা বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি আবার একটি অংশ নতুন করে ইজারা দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসনের বক্তব্য এবং বাস্তবতা
জেলা প্রশাসনের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, বালুমহাল হিসেবে ঘোষিত স্থানগুলো রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে ইজারা দিতে হয় এবং ইজারার সীমানা নির্দিষ্ট করা থাকে। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে যখন তার কাছে আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ দেখতে চাওয়া হয়, তখন তিনি তা দেখাতে পারেননি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, কারণ আইন থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগে দুর্বলতা থাকতে পারে।
নতুন একজন ইজারাগ্রহীতা জানিয়েছেন যে, তিনি ইজারা নিয়েছেন তবে এখনো বুঝিয়ে পাননি। আগের ক্ষতির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলেও দাবি করেন। তবে তিনি বলেছেন যে, আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই এবং তিনি ইজারার দাগের বাইরে বালু উত্তোলন করবেন না।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের উপর প্রভাব: কেন এটি আপনার জন্য জরুরি?
চকরিয়ার এই সংরক্ষিত বনভূমি উজাড় হওয়ার ঘটনা কেবল একটি স্থানীয় পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বনভূমি, বিশেষ করে ম্যানগ্রোভ বা উপকূলীয় অঞ্চলের কাছাকাছি থাকা বনগুলো প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। তারা ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং ভূমিধস থেকে উপকূলকে রক্ষা করে। গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বনভূমি ধ্বংস মানে এই প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়া, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, যেমন – ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি বা ভূমি ক্ষয় -এর ঝুঁকি বাড়ায়।
এছাড়াও, বনভূমি অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়া পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। হাতির মতো বিপন্ন প্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র ধ্বংস করা মানে কেবল একটি প্রজাতির ক্ষতি নয়, এটি পুরো বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
আমাদের কী করণীয়? পরিবেশ রক্ষায় আপনার ভূমিকা
এই ধরনের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পরিবেশ রক্ষা কেবল সরকারি দায়িত্ব নয়, আমাদের প্রত্যেকের এতে ভূমিকা রাখা জরুরি। চকরিয়ার বনভূমি রক্ষায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আপনিও আপনার জায়গা থেকে কিছু করতে পারেন:
১. সচেতনতা বৃদ্ধি: এই সমস্যা সম্পর্কে নিজে জানুন এবং আপনার পরিবার, বন্ধু এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের জানান। জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
২. কর্তৃপক্ষকে জানান: যদি আপনি পরিবেশ বিধ্বংসী কোনো কার্যকলাপের খবর পান, তবে দ্রুত বন বিভাগ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান।
৩. পরিবেশবাদী সংগঠনকে সমর্থন: যারা বনভূমি ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে এমন বিশ্বস্ত সংগঠন আছে, তাদের কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হন বা আর্থিক সহায়তা দিন। আপনার ছোট অনুদানও অনেক কাজে আসতে পারে।
৪. পরিবেশ-বান্ধব জীবনযাপন: পরিবেশের উপর আপনার নিজের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করুন। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা, বিদ্যুৎ ও পানির অপচয় রোধ করা – এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলো পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখে।
৫. দাবী তুলুন: বনভূমি রক্ষা এবং অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আপনার দাবি জানান।
কক্সবাজারের চকরিয়ার সংরক্ষিত বনভূমি আমাদের জাতীয় সম্পদ। ইজারার আড়ালে হোক বা প্রকাশ্যেই হোক, বনভূমি উজাড় হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রকৃতির এই দানকে রক্ষা করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় শক্তিশালী বনভূমি টিকিয়ে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আসুন, আমরা এই ব্যাপারে সচেতন হই এবং পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। আপনার নীরবতা নয়, আপনার সচেতনতাই পারে এই বনভূমিকে বাঁচাতে।
আপনি কি আপনার আশেপাশে পরিবেশ বিধ্বংসী কোনো কার্যকলাপ লক্ষ্য করেছেন? বনভূমি বা নদী রক্ষায় আপনি কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন বলে মনে করেন? নিচে কমেন্ট করে আপনার মতামত জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি শেয়ার করে অন্যদেরও জানানোর সুযোগ করে দিন!