রামু উপজেলায় পরিবেশ বিষয়ক নিয়ম-নীতির চরম লঙ্ঘন কেবল গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকেই বিপন্ন করছে না, বরং একটি ক্রমাবনতিশীল পরিবেশগত সংকট তৈরি করছে। গর্জনিয়া ইউনিয়নের কাজিরবিল সেতুর কাছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে স্বল্পমেয়াদী লাভের আশায় সেতুর গঠনগত অখণ্ডতা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং একই সাথে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাঁকখালী নদীর সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র। রামুতে অবৈধ বালু উত্তোলন
সেতুর বাইরেও: অবরুদ্ধ এক বাস্তুতন্ত্র:
কাজিরবিল সেতুর তাৎক্ষণিক বিপদটি উদ্বেগজনক হলেও, অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ব্যাপক পরিবেশগত পরিণতি আরও গভীর। বাঁকখালী নদীর মোহনা থেকে বালু উত্তোলনের ফলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে:
- নদী তলদেশের অবনতি: ড্রেজিং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করে, নদীর তলদেশকে অস্থির করে তোলে এবং ভাঙন বৃদ্ধি করে। এটি কেবল সেতুকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে না, পুরো জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থাকেও পরিবর্তন করে দেয়। রামুতে অবৈধ বালু উত্তোলন
- জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: নদীর তলদেশ এবং সংলগ্ন ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র মাছ, ক্রাস্টাশিয়ান এবং মোলাস্কসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় আবাসস্থল। বালু উত্তোলন এই আবাসস্থলগুলো ধ্বংস করে, যার ফলে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায় এবং স্থানীয় মৎস্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- পানি দূষণ: বালু উত্তোলনের প্রক্রিয়ায় তলানিগুলো আলোড়িত হয়, যা ঘোলাত্ব বাড়িয়ে পানির গুণাগুণ কমিয়ে দেয়। এটি জলজ জীবনকে প্রভাবিত করে, জলজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণকে বাধা দেয় এবং পানিকে মানুষের ব্যবহারের জন্য কম উপযোগী করে তোলে।
- উপকূলীয় ভাঙন বৃদ্ধি: ম্যানগ্রোভ বন যা ঝড় ও উপকূলীয় ভাঙন থেকে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে, তা বাংলাদেশে এমনিতেই হুমকির মুখে। বালু উত্তোলন এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তোলে, যা উপকূলীয় সম্প্রদায়কে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
আইনের প্রতি অবজ্ঞা: বিপর্যয়ের পথ
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। তবে, এই আইনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা পরিবেশগত শাসনের একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা প্রদর্শন করে।
ডমিনো প্রভাব:
কাজিরবিল সেতুর কাছে অবৈধ বালু উত্তোলন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি একটি বৃহত্তর সমস্যার লক্ষণ। টেকসই নয় এমন সম্পদ উত্তোলনের অনুশীলনগুলো সারা বাংলাদেশে পরিবেশগত অবনতিতে অবদান রাখছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলছে। রামুতে অবৈধ বালু উত্তোলন
ঘটনাস্থলের চিত্র হতাশাজনক:
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন যে, ড্রেজিং সরঞ্জাম ব্যবহার করে সেতুর কাছাকাছি স্থানে লম্বা পাইপের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি এবং ঘোলা জল পরিবেশগত ক্ষতির একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।
পরিবেশগত ন্যায়বিচারের জন্য আকুল আবেদন:
কাজিরবিল গ্রামের উদ্বিগ্ন নাগরিকরা তাদের নদী ও সম্প্রদায়ের ধ্বংস নিয়ে ক্রমশ চিন্তিত। তারা বুঝতে পারছে যে, শুধুমাত্র সেতুই ঝুঁকির মধ্যে নয়; তাদের জীবনযাত্রাও হুমকির মুখে।
সরকারি প্রতিক্রিয়ার মূল্যায়ন:
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা পরিস্থিতির অবৈধতা স্বীকার করলেও, কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে পরিবেশ সুরক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা ভাবছেন কেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
সিস্টেমিক পরিবর্তনের আহ্বান:
কাজিরবিল সেতুর সংকট শুধুমাত্র অবৈধ বালু উত্তোলনের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারী করার চেয়েও বেশি কিছু দাবী করে। এটি একটি মৌলিক মানসিকতার পরিবর্তনের আহ্বান জানায়, পরিবেশ সুরক্ষা উন্নয়নের পথে বাধা নয় বরং টেকসই সমৃদ্ধির জন্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি—এই স্বীকৃতি প্রয়োজন।
আমাদের সমাজকে অবশ্যই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে টেকসই উন্নয়নকে গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে স্থানীয় সম্প্রদায় এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সাথে যথাযথ পরামর্শ করা অন্তর্ভুক্ত। আমাদের চারপাশের বিশ্বকে ধ্বংস করে একটি টেকসই অর্থনীতি অর্জন করা সম্ভব নয়।
আমরা কি করতে পারি?
- পরিবেশ আইন ও বিধিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
- পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে টেকসই বালু উত্তোলন অনুশীলনে বিনিয়োগ করতে হবে।
- বালুর চাহিদা কমাতে বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী প্রচার করতে হবে।
- পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আরও জানতে: পরিবেশ বিষয়ক নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন।