যা শুরু হয়েছিল একটি ছোট সমাবেশ হিসেবে, তা এখন এক চমৎকার দৃশ্যে পরিণত হয়েছে – নান্দাইল উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের রংগারপাড় নামক স্থানে একটি রেইনট্রি গাছে হাজার হাজার বাদুড় আশ্রয় নিয়েছে। কৃষক আব্দুল মান্নানের বাড়ির পেছনের এই গাছটি এখন বাদুড়ের এক অসাধারণ কলোনিতে পরিণত হয়েছে। এটি এলাকাটিকে এক আকর্ষণীয় দৃশ্যে রূপান্তরিত করেছে, তবে এটি পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে বন্যপ্রাণীর আচরণের ওপর প্রভাব সম্পর্কেও প্রশ্ন জাগায়। নান্দাইলে রহস্যময় বাদুড় কলোনি
সন্ধ্যাবেলার এক দৃশ্য:
দেওয়ানগঞ্জ সড়কের পাশে অবস্থিত আব্দুল মান্নানের বাড়ির পেছনের রেইনট্রি গাছটি হাজার হাজার বাদুড়ের এক অপ্রত্যাশিত আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। চারপাশে বাঁশঝাড় থাকা সত্ত্বেও, বাদুড়গুলো ক্রমাগত এই গাছটিকেই বেছে নিয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে এলাকাটি কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে এবং বাদুড়গুলো উড়তে শুরু করে। নান্দাইলে রহস্যময় বাদুড় কলোনি
শত শত বাদুড়ের রক্তিম গোধূলির আকাশে উড়ে বেড়ানো দৃশ্য প্রকৃতির এক শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বাদুড়গুলো খাদ্যের সন্ধানে দলবদ্ধভাবে উড়ে যায়, যা দেখে মনে হয় যেন আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে।
অভয়ারণ্য, কোনো হুমকি নয়:
বাড়ির মালিক আব্দুল মান্নান জানান, প্রায় ২৪ বছর আগে হঠাৎ করেই বাদুড়গুলো এখানে এসে আশ্রয় নেয়। “অনেক বাদুড় হঠাৎ করে আমার বাড়ির পেছনের রেইনট্রি গাছটিতে এসে আশ্রয় নেয়,” তিনি বলেন। “তারা দিনের বেলা থাকে, কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে পুরো গাছ খালি হয়ে যায়। মনে হয় যেন আর আসবে না। কিন্তু ভোর হওয়ার সাথে সাথেই তাদের কিচিরমিচির শব্দে এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙে।”
প্রথমদিকে, বাদুড়গুলো রোগ ছড়াতে পারে এমন উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল এবং তাদের তাড়ানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল। তবে, তারা যায়নি এবং এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে তারা কারো কোনো ক্ষতি করে না। ধীরে ধীরে বাদুড়গুলোকে কোনো রকম ব্যাঘাত ছাড়া বসবাস করতে দেওয়া হয়েছে। নান্দাইলে রহস্যময় বাদুড় কলোনি
মান্নান বলেন, “আমাদের বাড়িটির পরিচিতি অনেক বদলে গেছে।” “অনেকেই এখন একে ‘বাদুড় বাড়ি’ বলেও ডাকে।”
বাদুড়: শুধু ক্ষতিকর নয়:
নান্দাইল সমূর্তজাহান কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অরবিন্দ পাল অখিল জানান, বাদুড় পাখি হিসেবে পরিচিত হলেও এটি মূলত একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরাই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা আকাশে ডানা মেলে উড়তে পারে। পৃথিবীতে প্রায় ১১শ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। এদের আদি বাসস্থান যুক্তরাজ্যে হলেও বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই বাদুড় দেখা যায়। স্তন্যপায়ী এই প্রাণীর প্রধান খাদ্য হলো ফলমূল।
অখিল আরও বলেন, বাদুড় কিছু রোগের জীবাণু বহন করলেও পরাগায়ন সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দিনের বেলা পুরানো ভাঙাচোরা বাড়ি, ঘর, দালান বা বন বাদারে গাছের ডালে ঝুলে থাকে এই বাদুড়। গাছের উঁচু ডালে পা দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে নেয় তারা। বাদুড়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এরা কোনো বাসা বাঁধে না। ডিমও পাড়ে না; মুখ দিয়ে বাচ্চা প্রসব করে। সকল বাচ্চা তার মায়ের বুকের সাথে ঝুলে থেকে বড় হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব?
তবে, এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়: কেন এই বাদুড়গুলো অন্য গাছপালা বাদ দিয়ে এই বিশেষ রেইনট্রি গাছটিকে বেছে নিয়েছে? এর পিছনে কি জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো প্রভাব আছে? পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খাদ্য সংকট, আবাসস্থলের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাদুড়গুলো তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করছে।
নান্দাইলের এই বাদুড় কলোনি একদিকে যেমন প্রকৃতির এক अद्भुत সৃষ্টি, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যপ্রাণীদের বাসস্থান পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিতও বটে।
আমরা কি করতে পারি?
আমাদের উচিত এই বাদুড়গুলোর আবাসস্থল রক্ষা করা এবং তাদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য পরিবেশ সুরক্ষায় আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
- বাদুড়দের আবাসস্থল ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকুন।
- কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে ফল ও অন্যান্য গাছের উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করুন, যাতে তারা খাদ্য পায়।
- এলাকার পরিবেশ সুরক্ষায় স্থানীয় সংগঠনগুলোকে সহায়তা করুন।
এই বাদুড় কলোনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতি কতটা ভঙ্গুর এবং এর সুরক্ষার জন্য আমাদের কতটা সচেতন হওয়া উচিত।
আপনার মতামত কি? নান্দাইলের এই বাদুড় কলোনি সম্পর্কে আপনার কি মনে হয়? নিচে মন্তব্য করে জানান।