ভূগর্ভস্থ জলের অবাধ ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবাদীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। এবার সেই উদ্বেগকে আমলে নিয়ে শিল্পকারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে মূল্য পরিশোধের কথা বললেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গাজীপুরে অনুষ্ঠিত ‘নদী ও জলাভূমি সিম্পোজিয়াম ২০২৫’ অনুষ্ঠানে তিনি এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। কিন্তু এই পদক্ষেপ কতটা বাস্তবসম্মত, আর পরিবেশ সুরক্ষায় এর প্রভাবই বা কী হতে পারে, তা নিয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণ করা যাক। ভূগর্ভের জল ব্যবহার
ভূগর্ভস্থ জলের সংকট: কেন এই পদক্ষেপ?
ভূগর্ভস্থ জল আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু শিল্পকারখানাগুলো নির্বিচারে এই জল ব্যবহার করার কারণে এর স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে জলের অভাব, অন্যদিকে দেখা দিচ্ছে পরিবেশগত নানা সমস্যা। ভূগর্ভস্থ জলের স্তর হ্রাসের কারণে অনেক এলাকায় জলের স্তর এতটাই নিচে নেমে গেছে যে, সাধারণ নলকূপ থেকে জল তোলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। জলের স্তর নিচে নেমে গেলে আর্সেনিকের ঝুঁকি বাড়ে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এছাড়া ভূগর্ভস্থ জল কমে গেলে মাটির গঠন দুর্বল হয়ে যায়, যার কারণে ভূমিধসের সম্ভাবনা বাড়ে। ভূগর্ভের জল ব্যবহার
রিজওয়ানা হাসান জানান, জলাধার ও নদীদূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পকারখানার ব্যবহৃত পানি পুনর্ব্যবহার করতে বাধ্য করতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে শিল্পকারখানাগুলো জলের ব্যবহারে আরও বেশি সতর্ক হবে এবং বিকল্প উৎস খুঁজতে উৎসাহিত হবে বলে আশা করা যায়।
গাজীপুরের নদী ও জলাভূমি: এক করুণ চিত্র:
গাজীপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, বানার, চিলাই, লবণদহ, শালদহ, গোয়ালী, তুরাগ, বংশী, বালু, গোয়াল্লার, পারুলীর মতো নদ-নদীগুলোর চিত্র উদ্বেগজনক। এক সময়ের স্রোতস্বিনী নদীগুলো আজ দখল আর দূষণে জর্জরিত। বোলাই, মকশ বিলের মতো স্বাদুপানির জলাধারগুলোও আজ বিপন্ন।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই জেলার পানির গুণগত মান আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। কোথাও কোথাও পানিতে দ্রবণীয় অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যের ঘরে নেমে এসেছে। এর প্রধান কারণ হলো নদীদূষণ। এই পরিস্থিতিতে নদী ও জলাভূমিকে রক্ষা করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ভূগর্ভের জল ব্যবহার
সিম্পোজিয়ামের প্রস্তাবনা:
নদী ও জলাভূমি সিম্পোজিয়াম থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো নদীগুলোর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা এবং নদীর পাড় বাঁধাই করা, শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা বন্ধ করা, জলাধারগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং খনন করা, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা এবং ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প জলের উৎস তৈরি করা। এসব প্রস্তাবনার দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে গাজীপুরের নদী ও জলাভূমিগুলোকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
বাস্তবায়নের পথে বাঁধা:
নীতি প্রণয়ন করা যত সহজ, বাস্তবায়ন করা তত কঠিন। শিল্পকারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে মূল্য ধার্য করার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক শিল্পমালিকই চাইবেন না জলের জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে। তারা নানা অজুহাতে এই নিয়ম এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতে পারেন। এই নীতি কার্যকর করার জন্য একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রয়োজন, যারা নিয়মিত জলের ব্যবহার নিরীক্ষণ করবে এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া শিল্পকারখানাগুলোর জন্য বিকল্প জলের উৎস তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, নদীর জল পরিশোধন এবং বর্জ্য জল পুনর্ব্যবহারের মতো বিকল্প উৎসগুলো তৈরি করতে সময় এবং অর্থের প্রয়োজন।
ঢাকার চার নদী: ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা:
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকার চারটি নদী (বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ) দখল-দূষণমুক্ত করার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার কথা বলেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, এই কাজ তার সময়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, তার সময়ে তুরাগ নদের পুনরুদ্ধার শুরু হবে। ঢাকার নদীগুলো দখল-দূষণের শিকার হওয়ার কারণে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে নৌ চলাচল এবং মাছের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। এই নদীগুলোকে বাঁচাতে না পারলে ঢাকার ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে।
সফলতার সম্ভাবনা:
সঠিক পরিকল্পনা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন করা গেলে শিল্পকারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে মূল্য ধার্য করার এই উদ্যোগ সফল হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সহযোগিতা, সরকার, শিল্পমালিক, পরিবেশকর্মী এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। নিয়ম কার্যকর করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে জলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের শাস্তি দিতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করার জন্য শিল্পকারখানাগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে।
ভূগর্ভস্থ জলের মূল্য নির্ধারণের এই পদক্ষেপ একটি সাহসী উদ্যোগ। এর মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি জলের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। তবে এর সফলতা নির্ভর করছে এর সঠিক বাস্তবায়ন এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর।
আপনার মতামত:
শিল্পকারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে মূল্য ধার্য করা কি সঠিক পদক্ষেপ? এই বিষয়ে আপনার মতামত কী? আপনি যদি শিল্পমালিক হন, তাহলে এই সিদ্ধান্তের প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়া কী? নিচে মন্তব্য করে আপনার মতামত জানান। আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করি।