“বৃষ্টি যেন ধানচাষিদের কান্না হয়ে ঝরছে” – নওগাঁর মাঠের এই হাহাকার জলবায়ু পরিবর্তনের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। যে বৃষ্টি কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পারতো, আজ সেটাই তাদের চোখের জলে পরিণত হয়েছে। বোরো ধানের সোনালী স্বপ্ন এখন ফিকে হয়ে যাচ্ছে অসময়ের বৃষ্টিতে। বৃষ্টির পানিতে সব শেষ
সোনার ফসল যখন চোখের জল:
নওগাঁর মান্দা উপজেলার বড় বেলালদহ গ্রামের চিত্র যেন সারাদেশের কৃষকদের প্রতিচ্ছবি। বর্গা জমিতে ধান চাষ করে যাদের সংসার চলে, তাদের কাছে এই ফসল শুধু খাদ্য নয়, বেঁচে থাকার অবলম্বন। চার মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যখন ফসল ঘরে তোলার সময় হয়, তখনই নামে এই অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ। বৃষ্টির পানিতে সব শেষ
তিন বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন, এমন একজন কৃষক জানান, সোনার ফসল ফলানোর জন্য তিনি দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। কোনো প্রকার ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু ফসল কাটার পর বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তার সব কষ্ট মাটি হতে চলেছে। শ্রমিক লাগিয়ে ধান কেটে মাঠে ফেলে রেখেছেন শুকানোর জন্য, কিন্তু গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে সেই ধান নষ্ট হতে চলেছে।
এই চিত্র শুধু একটি গ্রামের নয়, একই অবস্থা ওই এলাকার আরও অনেক কৃষকের। যারা সরিষা ও আলু চাষের পর জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছিলেন, তাদের ধান পাকতে একটু দেরি হয়েছে। আর এই দেরির কারণে এখন অসময়ের বৃষ্টির কবলে পড়েছেন তারা।
কেন এই বিপর্যয়?
এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমেই আসে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা। আবহাওয়ার পরিবর্তন এখন এতটাই দ্রুত হচ্ছে যে, কৃষকরা কোনো কিছুই অনুমান করতে পারছেন না। কখন বৃষ্টি হবে, কখন খরা দেখা দেবে – বলা মুশকিল। বৃষ্টির পানিতে সব শেষ
- অনিয়মিত বৃষ্টিপাত: আগে বর্ষা শুরু এবং দেরিতে শেষ হওয়ার কারণে কৃষকরা চাষাবাদের সময় নিয়ে দ্বিধায় থাকেন।
- তাপমাত্রা পরিবর্তন: অতিরিক্ত তাপমাত্রা ফসলের জন্য ক্ষতিকর।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে, যা কৃষকদের জন্য মারাত্মক হুমকি।
নওগাঁর বদলগাছীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েকদিনে নওগাঁয় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টি কৃষকদের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
কৃষি বিভাগের বক্তব্য:
মান্দা উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় বোরো আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ জমির ধান কাটা-মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আলু ও সরিষা তোলার পর বোরো লাগাতে দেরি হওয়ায় কৃষকেরা এই সমস্যায় পড়েছেন। অতিবৃষ্টির কারণে মাঠে থাকা ধানের বিষয়ে তাঁরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং কৃষকদের দ্রুত ধান কাটতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবে এই পরামর্শ কতটা কাজে লাগছে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, শ্রমিক সংকট এবং ভেজা ধান শুকানোর অভাবের কারণে অনেক কৃষকই ধান কাটতে পারছেন না।
ভবিষ্যতের পথে:
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কিছু দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
- জলবায়ু সহিষ্ণু শস্য: এমন ফসল উৎপাদন করতে হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে।
- সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন: বৃষ্টির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আধুনিক সেচ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
- কৃষি বীমা: ফসলের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে কৃষকদের জন্য কৃষি বীমার ব্যবস্থা করতে হবে।
- দুর্যোগ পূর্বাভাস: আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস আরও নির্ভুল করতে হবে, যাতে কৃষকরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারেন।
- কৃষকদের প্রশিক্ষণ: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
বৃষ্টি এখন আর আশীর্বাদ নয়, অনেক কৃষকের কাছে এটা কান্নার কারণ। এই কান্না থামাতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে এবং কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নতুবা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
আপনার ভাবনা:
বৃষ্টি কি আসলেই ধানচাষিদের কান্না হয়ে ঝরছে? আপনার মতামত কী? আপনি যদি কৃষক হন, তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করুন। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসি।