সিলেট শহরকে দ্বিখণ্ডিত করা সুরমা নদী স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য ক্রমশ উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রবল বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে নদীর দুই পাড়ের লাগামছাড়া ভাঙন শুধু জনবসতিকেই বিপন্ন করছে না, বরং যমুনা অয়েল ডিপোর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকেও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই সংকট বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন (-এর বিধ্বংসী প্রভাবকে স্পষ্ট করে তোলে এবং আমাদের পরিবেশ সুরক্ষায় জরুরি ও টেকসই সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সুরমা নদীর এপার ভাঙছে, ওপারও ভাঙছে, যমুনা অয়েলের ডিপো ঝুঁকিতে। সুরমা নদীর রুদ্ররূপ
আতঙ্কের নগর: প্রতি বর্ষায় বাড়ছে ভাঙনের তীব্রতা
গত কয়েক বছর ধরে বর্ষাকালে সুরমা নদী তার দুই তীরকে ক্রমাগত গ্রাস করছে, যা শহরের বিভিন্ন অংশে প্রভাব ফেলেছে। ভাঙনের পাশাপাশি প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে নদীর জল উপচে বন্যাও দেখা দিচ্ছে। এ বছর বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই নদীভাঙন শুরু হওয়ায় শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি উঠেছে। সুরমা নদীর রুদ্ররূপ
বিপন্ন জনজীবন: হুমকির মুখে ঘরবাড়ি ও জীবিকা
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই শহরের উত্তর অংশের কালীঘাট আমজাদ আলী রোড গাঙপার এবং দক্ষিণ অংশের খোজারখোলা এলাকায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এতে উভয় অংশের ঘরবাড়ি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এছাড়াও, কুশিঘাট এলাকায় নদীর উভয় তীরেই ক্রমাগত ভাঙন চলছে। যদিও এই তিনটি এলাকায় প্রতি বছরই ভাঙন দেখা যায়, তবে এ বছর ভাঙনের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
আমজাদ আলী রোড গাঙপার এলাকার পাশের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ (২৪), যিনি সোবহানীঘাট সবজি বাজারে শ্রমিকের কাজ করেন, তিনি বলেন, “১০-১৫ দিন আগে ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রথমে ফাটল দেখা দিয়েছিল, তারপর ধীরে ধীরে পার ভাঙতে শুরু করে। এখন প্রতিদিন ভাঙছে।”
সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির কারণে নদী পানিতে পরিপূর্ণ এবং প্রবল স্রোত বিদ্যমান। আমজাদ আলী রোডের নদীর তীরের প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ গজ অংশে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। আশেপাশের বাড়িঘর ও স্থাপনা থেকে নদীর পার অন্তত ৭-১০ হাত দূরে ভাঙছে, যা প্রায় ১০টি বাড়ি ও পাকা বিল্ডিংকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
যমুনা অয়েল ডিপো: একটি সম্ভাব্য বিপর্যয়
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, খোজারখোলা এলাকায় নদীর পার ভাঙনের ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (জেওসিএল) সিলেট ডিপো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই ডিপোটি সিলেট অঞ্চলের জ্বালানি সরবরাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাঙন ঠেকাতে ও ডিপো রক্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত অংশে কিছু জিওব্যাগ (বালুর বস্তা) ফেলা হয়েছে। সুরমা নদীর রুদ্ররূপ
যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের ‘স্বাধীন পরিচালক’ সালেহ আহমদ খসরু বলেন, “নদীভাঙনের খবর পেয়ে স্থানটি পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দেখতে পাই। নদীভাঙনের কারণে পুরো জেটি হুমকির মুখে পড়েছে। তাই তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। পাউবো ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে কাজও শুরু করেছে। তবে এখানে স্থায়ী ব্লক বসানো প্রয়োজন।”
স্থানীয়দের দাবি: শহর রক্ষা বাঁধের প্রয়োজনীয়তা
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বর্ষায় ধারাবাহিকভাবে নদীভাঙনের পাশাপাশি সুরমা নদীর পানি উপচে বন্যা দেখা দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে সুরমা নদীর নগর অংশের অনেক স্থান নাব্যতা হারালেও খনন করা হয়নি। তাই বন্যার সমস্যা দূর করতে নদী খননের পাশাপাশি নগরবাসী দীর্ঘদিন ধরে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। শহর রক্ষা বাঁধ নির্মিত হলে নদীভাঙন ঠেকানোর পাশাপাশি বন্যাও অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, কুশিঘাট এলাকায় নদীভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাউবোকে লিখিতভাবে বলা হয়েছে। আমজাদ আলী রোড ও খোজারখোলা এলাকায়ও একই উদ্যোগ নিতে পাউবোকে বলা হবে। এছাড়া ভাঙন ও বন্যা ঠেকাতে স্থায়ীভাবে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের রয়েছে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, নদীভাঙনে খোজারখোলা এলাকায় যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের সিলেট ডিপোটি ঝুঁকিতে পড়েছে। এ অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ এ স্থাপনা রক্ষায় নদীভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইভাবে আলী আমজাদ রোড ও কুশিঘাট এলাকায়ও দ্রুততার সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
দুর্যোগের কারণ: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুরমা নদীর এই লাগামছাড়া ভাঙনের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি ঢল এবং নদীর নাব্যতা হ্রাস—সবকিছুই এই ভাঙনকে ত্বরান্বিত করছে।
এ অবস্থায়, শুধু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও টেকসই সমাধানের ওপর জোর দেওয়া উচিত। নদী খনন, শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
আমাদের করণীয়:
- পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো সম্পর্কে জানা ও প্রতিরোধ করা।
- স্থানীয় প্রশাসনকে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য চাপ দেওয়া।
- নদী খননের ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া।
- দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা।
আসুন, আমরা সবাই মিলে সুরমা নদীর ভাঙন রোধে এগিয়ে আসি এবং সিলেট শহরকে রক্ষা করি।