একসময়ের শস্য-শ্যামল চট্টগ্রামে আজ এক উদ্বেগজনক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। পূর্বে যে অঞ্চলগুলো বছরে দুবার ধান চাষের জন্য পরিচিত ছিল, সেগুলো এখন বিশাল গর্ত ও জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। উর্বর মাটি, যা এই কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের মূল ভিত্তি, তা ক্রমাগতভাবে ইটভাটায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পরিবেশগত অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে। ইটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং অবৈধ কার্যকলাপের কারণে এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে। ফসলি জমি গিলে খাচ্ছে ইটভাটা
বাস্তবতার এক কঠিন চিত্র: ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী
সম্প্রতি বোরো মৌসুমের ধান ক্ষেত পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয় কৃষকেরা এক ভিন্ন দৃশ্য দেখতে পান। সবুজ ধানক্ষেতের পরিবর্তে বিশাল বিশাল গর্ত চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যেগুলোর গভীরতা ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত। এই গর্তগুলোতে পানি জমে কৃত্রিম পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে একসময় ফসল ফলানো হতো। মাটির ব্যবসায়ীরা ইটভাটার জন্য মাটি কাটার ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফসলি জমি গিলে খাচ্ছে ইটভাটা
জমির কান্না: কৃষকদের হতাশা
এলাকার এক প্রবীণ কৃষক এই পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন: “যেখানে এখন বিশাল জলাশয়, সেখানে একসময় কৃষকেরা ধান চাষ করত। মাটি ব্যবসায়ীরা ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করার কারণে এই জলাশয় তৈরি হয়েছে। এমনকি অনেকের জমি থেকে জোর করে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” অভিযোগ উঠেছে যে, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কিছু ব্যক্তি এই মাটির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, যা কৃষকদের শোষণ করছে এবং পরিবেশের ক্ষতি করছে।
বাস্তব চিত্র: ধ্বংসের প্রমাণ
এলাকাটি পরিদর্শন করে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। একটি বিশাল কৃত্রিম হ্রদ পুরো এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যার পাশে দেখা যায় সদ্য কাটা ধান গাছের গোড়া। কাছাকাছি কয়েকটি ইটভাটা দৃশ্যমান, যা মাটি কাটার প্রধান কারণ। পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেও একই ধরনের বিশাল গর্ত এবং ইটভাটার চিত্র দেখা যায়, যা পরিবেশ বিপর্যয়ের এক করুন প্রতিচ্ছবি।
পরিসংখ্যান: ক্ষতির পরিমাণ
স্থানীয় কৃষক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এই সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে জানা যায়। এই এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইটভাটা রয়েছে। স্থানীয় মাটি ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে দো-ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছেন, যার ফলে অনেক আবাদি জমি জলাশয় এবং বিশাল গর্তে পরিণত হয়েছে।
ইটভাটা মালিকদের ভাষ্য: চাহিদার টানাপোড়েন
ইটভাটা মালিক সমিতির একজন প্রতিনিধি এই পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করেন: “ইটভাটার প্রধান কাঁচামাল হলো মাটি। আমরা মাটি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাটি কিনে ইট তৈরি করি। কিছু ফসলি জমি থেকে গভীর করে মাটি কাটার কারণে কিছু কিছু স্থানে জলাশয় ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক আগে থেকেই এসব জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছিল।” পরিবেশগত ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েও তিনি এই শিল্পের চাহিদার কথা উল্লেখ করেন।
সরকারি পদক্ষেপ: প্রতিরোধের সংগ্রাম?
স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ মাটি কাটার বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মাটি কাটা বন্ধ করার জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। অবৈধ কার্যকলাপের খবর পাওয়া মাত্রই ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীদের জেল ও জরিমানা করা হয়েছে। খননযন্ত্র ও ট্রাক জব্দ করা হয়েছে, এবং কিছু অকেজো করে দেওয়া হয়েছে।
তবে এসব প্রচেষ্টা যেন পরিস্থিতি সামাল দিতে যথেষ্ট নয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, যারা এই কাজের সাথে জড়িত, তারা অভিযানের খবর আগে থেকেই পেয়ে যায়, ফলে অপরাধীরা সহজেই এড়িয়ে যায়।