25.4 C
Bangladesh
শুক্রবার, মে ৩০, ২০২৫
spot_img

উপকূলে ঝাঁটা বিদ্রোহ! জীবন নাকি চিংড়ি, কী বেছে নেবে বাংলাদেশ?

খুলনার কয়রা। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা নয়ানী গ্রাম। শান্ত জনপদ হঠাৎ যেন ফুঁসছে। সড়কের পাশে জমায়েত, কণ্ঠে তীব্র স্লোগান – “নোনাপানির পক্ষে যারা, উপকূলের শত্রু তারা“। নারীরা ঝাঁটা উঁচিয়ে প্রতিজ্ঞা করছেন, “নোনাপানি তুলতে এলে মুখে দেব ঝাঁটার বাড়ি”। এই দৃশ্য শুধু একটি গ্রামের নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে টিকে থাকার এক সম্মিলিত প্রতিরোধের চিত্র। প্রশ্ন হলো, কেন আজ জীবন-জীবিকার প্রশ্নে ফুঁসে উঠেছে উপকূল, কেন নোনাজলের বিরুদ্ধে উড়ছে ঝাঁটা? উপকূলে ঝাঁটা বিদ্রোহ

নোনাপানির অভিশাপ: একটি উপকূলীয় ট্র্যাজেডি:

নয়ানী গ্রামের বিলগুলোতে প্রায় ২৫ বছর ধরে চিংড়ি ঘেরের রাজত্ব ছিল। নদীর লোনাজল ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করা হতো, যা আপাতদৃষ্টিতে লাভজনক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের জন্য ডেকে এনেছে বিপর্যয়। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এই ঘেরগুলোর কারণে তারা দীর্ঘকাল জমিতে ধান চাষ করতে পারেননি। মাটি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্য ফসল ফলানোও কঠিন হয়ে পড়ে। গত বছর, বহু বছর পর, যখন তারা সম্মিলিতভাবে ধান চাষ শুরু করেন, তখন তাদের মনে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন জেগেছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ আবারও হুমকির মুখে। অল্প কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বহিরাগতদের এনে ফের নোনাপানির ঘের তৈরি করতে উদ্যত হওয়ায় এলাকার মানুষ বাধ্য হয়েছেন প্রতিরোধের পথ বেছে নিতে। উপকূলে ঝাঁটা বিদ্রোহ

এই ঘটনার গভীরে লুকিয়ে আছে উপকূলীয় মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও অসহায়তার গল্প। নোনাপানির আগ্রাসন শুধু তাদের জীবিকাই কেড়ে নেয়নি, এটি তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

চিংড়ি বনাম ধান: উন্নয়নের কোন পথে উপকূল?

উপকূলীয় অর্থনীতিতে চিংড়ি চাষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, অস্বীকার করার উপায় নেই। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উন্নয়নের এই মডেল কি পরিবেশ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

গবেষণা বলছে, চিংড়ি ঘেরের কারণে উপকূলীয় এলাকার পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টি পানির উৎসগুলো দূষিত হয়ে যায়, যা শুধু কৃষিকাজ নয়, মানুষের জীবনধারণের জন্যও হুমকিস্বরূপ। এছাড়া, ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করে চিংড়ি ঘের তৈরি করার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। উপকূলে ঝাঁটা বিদ্রোহ

অন্যদিকে, ধান ও অন্যান্য শস্য চাষ শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, এটি স্থানীয় মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা করে। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন এমন একটি মডেল, যা পরিবেশ ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।

প্রশাসনের নীরবতা: কাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে?

নয়ানী গ্রামের মানুষ যখন জীবন-মরণ লড়াইয়ে নেমেছে, তখন স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, বারবার জানানোর পরেও প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই নীরবতা কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে?

প্রশাসনের উচিত দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং স্থানীয় জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা। নোনাপানির ঘের তৈরি বন্ধ করে কৃষিকাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। একইসাথে, পরিবেশের ক্ষতি করে এমন যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

জলবায়ু পরিবর্তন: অস্তিত্বের সংকট:

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা – সবকিছু মিলিয়ে উপকূলীয় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতিতে, নোনাপানির ঘেরের মতো পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা করা না গেলে, অদূর ভবিষ্যতে সেখানকার মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে।

নয়ানী গ্রামের মানুষের এই প্রতিরোধ শুধু একটি স্থানীয় ঘটনা নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এক বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ। এই আন্দোলন আমাদের শিখিয়ে দেয়, পরিবেশ রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া কতটা জরুরি।

আসুন, আমরা সবাই উপকূলীয় মানুষের পাশে দাঁড়াই এবং পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের দায়িত্ব পালন করি। আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ