রংপুর শহরের প্রাণস্বরূপ ঐতিহবাহী শ্যামাসুন্দরী খাল আজ যেন একটি ভাগাড়। আবর্জনা আর দূষণে জর্জরিত এই খালটি এখন মশা-মাছির বংশবৃদ্ধির আখড়া, যা রংপুরবাসীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। একদিকে অসহনীয় গরম, অন্যদিকে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং, আর তার ওপর মশার উপদ্রব – সব মিলিয়ে রংপুর শহরের মানুষ আজ অতিষ্ঠ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই যন্ত্রণা নিরসনে সিটি কর্পোরেশনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি। রংপুরের ঐতিহ্য শ্যামাসুন্দরী
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ
খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ না করার কারণে খালটি তার নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে। একসময় এই খালটি শহরের পয়ঃনিষ্কাশন এবং জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য খনন করা হয়েছিল। কিন্তু আজ এটি শহরের আবর্জনা ফেলার স্থানে পরিণত হয়েছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পুরো শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যা সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ ডেকে আনে।
যদিও সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তবে বাস্তবে এর প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। মশার বংশবিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না, মশার কামড়ের অত্যাচারে নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত। নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই পরিস্থিতির আশু সমাধানে তারা খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ এবং খালটির খনন ও সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায়, রোগবালাই আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
ইতিহাস বলছে, ১৮৯০ সালে রংপুরের তৎকালীন পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকী বল্লভ সেন তাঁর মা চৌধুরানী শ্যামা সুন্দরী দেবীর নামে এই খালটি খনন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল পৌর এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করা এবং ম্যালেরিয়ার প্রকোপ থেকে শহরবাসীকে রক্ষা করা। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটি শহরের পশ্চিম-উত্তর দিকে ঘাঘট নদীর উজান থেকে খনন শুরু করে শহরের ভেতর দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণে ভাটিতে গিয়ে আবার মিলিত হয়েছে। এটি নগরীর ধাপ পাশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সিপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, গোমস্তাপাড়া, সেনপাড়া, মুলাটোল, তেঁতুলতলা, নূরপুর, বৈরাগীপাড়া হয়ে মাহিগঞ্জের মরা ঘাঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। রংপুরের ঐতিহ্য শ্যামাসুন্দরী
কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে সংস্কার না করার কারণে শ্যামাসুন্দরী নামের এই ঐতিহ্যবাহী খালটি আজ নাব্যতা হারিয়ে প্রায় ভরাট হয়ে যেতে বসেছে। খালের দুই ধারে অবৈধ দখলের কারণে খালটি সরু হয়ে গিয়েছে, ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পুরো শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। একসময় এই খালে স্রোতধারা ছিল, যা এখন কেবল দূষিত কাদামাটির জলাধারে পরিণত হয়েছে।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়
১১৭ বছর পর ২০০৭ সালে তৎকালীন রংপুর পৌরসভা খালটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। তবে এখন পর্যন্ত সংস্কার কাজ শেষ না হওয়ায় শহরবাসীর মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে সংস্কারের নামে আর্থিক ব্যয় দেখানো হলেও, তা কেবল খাতাকলমেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। খালটি এখন ধসে গিয়ে ভরাট হয়ে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, যা মশা উৎপাদনের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে।
খালের উৎস মুখ থেকে মাহিগঞ্জ পাটবাড়ি পর্যন্ত খালের দুই পাশের প্রায় ১০ কিলোমিটার সংস্কারের জন্য আগে রংপুর বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় একটি জরিপ করা হয়েছিল। জরিপে কেল্লাবন্দ, রাধাবল্লভ, আলমনগর, রঘুনাথগঞ্জ ও ভগি এলাকার ১৭০ জন অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তবে সিটি কর্পোরেশন জানায়, ১৭০ জন অবৈধ দখলদারের মধ্যে ১১ জন আপত্তির কারণে উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত রয়েছে।
নগরীর রাধাবল্লভ এলাকার রিকশাচালক এবং গৃহবধূ জানান, তারা শুধু মশক নিধনের কথা শোনেন, বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ দেখেন না। দিন-রাত সবসময় মশা কামড়ায়, যা তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সামান্য বৃষ্টিতে খালের পাড়ের পাড়া-মহল্লায় খালের পানি উপচে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থী জানান, দিনের বেলাতেও মশার কামড়ের কারণে পড়াশোনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রংপুরের ঐতিহ্য শ্যামাসুন্দরী
শ্যামাসুন্দরী খাল খনন, সংস্কার ও পরিষ্কার করতে শহরবাসী বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন ও সমাবেশ করলেও, আশ্বাস ছাড়া কিছুই জোটেনি।
পরিবেশের উপর প্রভাব
এই খালের দূষণ শুধু জনজীবনকেই বিপর্যস্ত করছে না, বরং পরিবেশের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে:
- দূষিত পানি: খালের দূষিত পানি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে দূষিত করছে।
- জীববৈচিত্র্য হ্রাস: খালের দূষণের কারণে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে, যা জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।
- স্বাস্থ্যঝুঁকি: দূষিত পানিতে মশার বংশবিস্তার বাড়ার কারণে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া সহ বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
উত্তরণের উপায়
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
- অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ: খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে খালের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।
- খাল খনন ও সংস্কার: খালটি খনন ও সংস্কার করে এর নাব্যতা বাড়াতে হবে।
- নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: খালটিকে নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে।
- মশক নিধন কার্যক্রম: নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: খালটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক জানান, নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডেই মশক নিধন অভিযান শুরু হয়েছে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শহরবাসীর ভোগান্তি কমাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্যামাসুন্দরী খাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং খননের জন্য প্রকল্পের কাজ শুরু করার প্রক্রিয়া চলছে।
তবে, শুধু আশ্বাস নয়, দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপের মাধ্যমে রংপুরবাসীর এই দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধান করা হোক, এটাই এখন সকলের প্রত্যাশা।
আপনার মতামত জানান
শ্যামাসুন্দরী খালের এই পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মতামত কী? আপনি কী ধরনের পদক্ষেপ দেখতে চান? নিচে মন্তব্য করে আমাদের জানান। আপনার প্রতিটি মতামত আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সাহায্য করবে। পরিবেশ সুরক্ষায় আপনার সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
আরও জানতে ভিজিট করুন
যদি আপনি পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আরও জানতে চান, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন এবং আমাদের নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন। একসাথে কাজ করার মাধ্যমেই আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।