28.4 C
Bangladesh
সোমবার, জুন ২, ২০২৫
spot_img

সিলেটের সম্পদ লুট: আর কত লুট হলে টনক নড়বে?

সিলেটের পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকাগুলো (Environmentally Critical Area – ECA) থেকে অবাধে পাথর ও বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। পাহাড়, টিলা থেকে শুরু করে সমতল ভূমি পর্যন্ত, সবকিছুই এখন পাথর ও বালু ব্যবসায়ীদের দখলে। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসন এই লুটপাট বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অন্যদিকে, জেলা প্রশাসক নানা সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে সিলেটের পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উপর এর প্রভাব নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। সিলেটের সম্পদ লুট

ইসিএ গেজেট অনুযায়ী

২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পাথরকোয়ারি এলাকার ডাউকি নদীকে ইসিএ ঘোষণা করে। নদীর দুই পাশে ৫০০ মিটারসহ ১৪.৯৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই ইসিএ বিস্তৃত। গেজেটের ৮ নম্বর নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এই এলাকায় কোনো প্রকার যন্ত্র ব্যবহার করে বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে খনিজ সম্পদ আহরণ করা যাবে না। তবে, দুঃখজনক বিষয় হলো, গেজেট অনুযায়ী ইসিএ এলাকা চিহ্নিত করতেই সময় লেগে যায় প্রায় তিন বছর। এই সময়কালে অবাধে লুটপাট চলতে থাকে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, একটি বিশেষ সময়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে খনিজ সম্পদ লুটপাট বেড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, মাত্র ১০ দিনেই শত কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হয়েছে। তবে, এই লুটপাট এখনো থামেনি। সিলেটের সম্পদ লুট

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়

হাজার হাজার শ্রমিক নৌকা নিয়ে ইসিএ ঘোষিত জাফলং ডাউকি নদী থেকে বালি ও ছোট পাথর তুলছে। এসব খনিজ সম্পদ নদীর তীরে এনে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এরপর ট্রাকের মাধ্যমে বালি ও পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্থানীয়দের মতে, শুধু ডাউকি নদী থেকেই প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ট্রাক ৫০০ থেকে ৬০০ ঘনফুট বালি নিয়ে যাচ্ছে। রাতে এই চিত্র আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার পর বড় বড় ড্রেজার ও ভলগেট (বালু উত্তোলনের বড় নৌকা) প্রবেশ করে এবং রাতভর কয়েক লাখ ঘনফুট বালি সরিয়ে নেয়।

জাফলং থেকে নৌকায় প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার ডাউকি নদী ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যায়, নদীর তীরে সারি সারি বড় স্টিলের তৈরি নৌকা (ভলগেট) রাখা আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নৌকার মাঝি জানান, সন্ধ্যার পর এসব নৌকা জাফলং ব্রিজ পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আরও কিছুদূর সামনে এগোলেই বালির স্তূপ চোখে পড়ে। সেদিন সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথ অভিযান চালাচ্ছিল। সঙ্গে ছিলেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এসব বালি বাওরবাগ হাওড় ও তীতকুল্লি হাওড় এলাকার গোয়াইন নদী থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। সিলেটের সম্পদ লুট

স্থানীয় শিক্ষার্থী আজমল জানান

তারা ‘নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করে আসছেন, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। অভিযান শেষে গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছে তথ্য আছে এসব বালি ইসিএ এলাকা থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। তাই তারা সরকারের অনুকূলে সেগুলো জব্দ করছেন।

শুধু গোয়াইনঘাট নয়, কোম্পানীগঞ্জের অবস্থাও আরও ভয়াবহ। শাহ আরেফিন টিলায় দিনের বেলায় পাথর উত্তোলন চলছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি নয়। স্থানীয়রা জানান, একটি বিশেষ সময়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে একদিনের জন্যও পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়নি। তাদের মতে, শাহ আরেফিন টিলা থেকে ইতোমধ্যেই শতকোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।

একই উপজেলার পর্যটন এলাকা

ভোলাগঞ্জের রেলওয়ে বাঙ্কার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ধ্বংসস্তূপ। পাথর তুলতে গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে এবং বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, আগে রাতের আঁধারে লুটপাট চললেও এখন দিনেদুপুরে চলছে। তাদের ধারণা, এখান থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার পাথর ইতোমধ্যে লুট হয়েছে।

পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-র

সিলেটের সমন্বয়ক এই পরিস্থিতিকে স্মরণকালের ভয়াবহ লুটপাট হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে যা ঘটছে, তার দায় কোনোভাবেই স্থানীয় প্রশাসন এড়াতে পারে না। কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিনি প্রশাসনকে ব্যর্থ বলতে নারাজ। তার মতে, লুটপাট বন্ধ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে তাদের ব্যর্থ বলা যেত, কিন্তু যখন কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় না, তখন তাদের উদাসীন বলাই ভালো।

জেলা প্রশাসক জানান, প্রশাসনের কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং নানা সীমাবদ্ধতার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তিনি নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথা উল্লেখ করে জানান, অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই আবারও বালি ও পাথর উত্তোলন শুরু হয়। এসব দেখভাল ও লুটপাট বন্ধ করতে যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, তার ঘাটতি রয়েছে। তবে, দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে খনিজ সম্পদ লুটপাট বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি

এই ধরনের খনিজ সম্পদ লুটপাটের কারণে সিলেটের পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে। নির্বিচারে পাহাড় কাটা ও বালু উত্তোলনের ফলে ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়ছে, যা জনজীবন এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এছাড়া, নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

  1. ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস: পাহাড় ও টিলা কাটার কারণে মাটি আলগা হয়ে যায়, যা সামান্য বৃষ্টিতেই ভূমিধসের কারণ হতে পারে।
  2. নদীর নাব্যতা হ্রাস: অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে নদীর গভীরতা কমে যায়, যা নৌ চলাচলের জন্য বিপজ্জনক।
  3. জীববৈচিত্র্য ধ্বংস: খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ফলে বনভূমি ও জলাভূমি ধ্বংস হয়, যা স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
  4. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস: অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, যা খাবার পানির সংকট তৈরি করতে পারে।

আমাদের করণীয়

সিলেটের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

  1. সচেতনতা সৃষ্টি: পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
  2. লুটপাটের প্রতিবাদ: খনিজ সম্পদ লুটপাটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং অবৈধ কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে হবে।
  3. আইন প্রয়োগ: প্রশাসনকে পরিবেশ সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
  4. টেকসই উন্নয়ন: পরিবেশ-বান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, যা পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলে।

আপনার মতামত জানান

সিলেটের খনিজ সম্পদ লুটপাট নিয়ে আপনার মতামত কী? পরিবেশ রক্ষায় আপনি কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে চান? নিচে মন্তব্য করে আমাদের জানান। আপনার প্রতিটি মতামত আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সাহায্য করবে। পরিবেশ সুরক্ষায় আপনার সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

আরও জানতে ভিজিট করুন

যদি আপনি পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আরও জানতে চান, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন এবং আমাদের নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন। একসাথে কাজ করার মাধ্যমেই আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ