পান্থকুঞ্জ গণআদালতের রায়: নাগরিক অধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষার এক নতুন দিগন্ত রাজধানীর পান্থকুঞ্জ উদ্যান নিয়ে চলমান বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে গণ আদালত এক যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেছে। এই রায়ে পান্থকুঞ্জ সবার জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেখানে গাছরক্ষা আন্দোলনকারীদের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পান্থকুঞ্জে জনসাধারণের অবাধ প্রবেশ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গণস্বার্থ বিষয়ক এটিই ছিল প্রথম গণ আদালত, যা নাগরিক অধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। পরিবেশ সুরক্ষায় নতুন দিগন্ত
গণআদালত: নাগরিকের কণ্ঠস্বর
শুক্রবার বিকেলে পান্থকুঞ্জের উত্তর প্রান্তে অনুষ্ঠিত গণ আদালত এই রায় ঘোষণা করে। বাংলাদেশ গাছরক্ষা আন্দোলন ‘পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমা: জনগণ বনাম অন্তর্বর্তী সরকার’ শীর্ষক এই গণশুনানির আয়োজন করে। গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে গাছরক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা পান্থকুঞ্জের গাছ কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (দ্রুতগতির উড়ালসড়ক) র্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। এরই অংশ হিসেবে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়। পরিবেশ সুরক্ষায় নতুন দিগন্ত
আদালতের এজলাসের মতোই লাল সালু
কাপড়ে আচ্ছাদিত বিচারকদের মঞ্চ, সাক্ষীদের কাঠগড়া, বিচারমঞ্চের উভয় পাশে বাদী ও বিবাদীপক্ষের আসন এবং সামনে দর্শকদের আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাদীপক্ষ উপস্থিত থাকলেও বিবাদীপক্ষে কেউ ছিলেন না, তাঁদের আসনগুলো খালিই ছিল। বিবাদীরা হলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সেতু বিভাগের নির্বাহী পরিচালক (সচিব), পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প পরিচালক।
বিচার কার্যক্রমের শুরুতে বাদীপক্ষের প্রসিকিউটরের ভূমিকা পালনকারী সমন্বয়ক আদালতকে জানান, বিবাদীপক্ষকে রেজিস্ট্রি ডাক, ই-মেইলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণশুনানিতে হাজির থাকার জন্য জানানো হলেও তাঁরা জনগণের পক্ষের এই আবেদনে সাড়া দেননি, বরং উপেক্ষা করেছেন। এটি জনগণের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতার অভাব প্রমাণ করে।
তিনি আরও জানান, গাছরক্ষা আন্দোলন
কোনো রাজনৈতিক দল বা বেসরকারি সংস্থা নয়, বরং প্রাণ, পরিবেশ, প্রকৃতি ও অধিকার আদায় নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম। গত ১৬৮ দিন ধরে তাঁরা পান্থকুঞ্জে অবৈধভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এই প্রকল্পে প্রায় দুই হাজার গাছ কাটা হয়েছে, বহু পাখি ও পতঙ্গের আবাস ধ্বংস হয়েছে। আশপাশের এলাকার মানুষের এই মিলনস্থল, প্রাতঃভ্রমণের জায়গাটি বিনষ্ট করা হচ্ছে।
সহকারী প্রসিকিউটরের ভূমিকায়
আরেক সমন্বয়ক আদালতের সামনে ছয়টি অভিযোগ তুলে ধরেন। এগুলো হলো অর্থনৈতিক অনিয়ম ও দুর্নীতি; সংবিধান, আইন ও আদালতের আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন; পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া প্রকল্পের কাজ করা; বৈষম্যমূলক চুক্তির মাধ্যমে জনগণের ওপরে জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া; প্রকল্প কাজের সময় দেশের নাগরিকের মৃত্যুর পরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দেওয়া; প্রকল্পের অজুহাতে হাতিরঝিল ভরাট এবং পান্থকুঞ্জের দুই হাজারের বেশি গাছ কাটা ও পাখি–পতঙ্গের বাসস্থান ধ্বংস করা।
এই অভিযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য–উপাত্ত এবং নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরে সাক্ষ্য দেন নগর পরিকল্পনাবিদ, লেখক ও গবেষক, পরিবেশকর্মী, পান্থকুঞ্জ প্রভাতি সংঘের সম্পাদক এবং একজন শিল্পী।
এজলাসে পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন একজন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য। অন্য সদস্যরা হলেন একজন অধ্যাপক, একজন দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান, একজন প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক এবং একজন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক।
রায়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
বিচারকমণ্ডলীর প্রধান জানতে চান বিবাদীপক্ষের কেউ উপস্থিত আছেন কি না এবং তাঁদের কোনো বক্তব্য আছে কি না। তাঁকে জানানো হয়, বিভিন্ন মাধ্যমে গণশুনানিতে হাজির থাকার জন্য অনুরোধ করা হলেও বিবাদীদের কেউ উপস্থিত হননি। এরপর বিচারকেরা রায়ের একেকটি অংশ ঘোষণা করেন।
একজন অধ্যাপক সদস্য বলেন, আদালত মনে করে, ভবিষ্যতে এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প গ্রহণ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। গোপনীয়তার অজুহাতে প্রকল্পের চুক্তি ও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনসমক্ষে না প্রকাশ করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এই গোপনীয়তার ফলে মেগা প্রকল্পেই দুর্নীতি হয়েছে। এই আদালত ভবিষ্যতের সব প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য তথ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিতের আদেশ প্রদান করছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পে যেসব দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা আজকের শুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে, সে বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করছে।
আরেকজন সদস্য বলেন, পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল জলাধারে নির্মাণকাজ চালানো হয়েছে। এ জন্য পুনরায় ছাড়পত্র প্রদান কিংবা নবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের ক্ষতিপূরণ আদায়সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হলো। তা ছাড়া পান্থকুঞ্জ উদ্যানের দুই হাজার গাছ কেটে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানোর কারণে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
আরেকজন সদস্য বিবাদীপক্ষের আইন অমান্য করার প্রবণতার কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং তীব্র তিরস্কার করেন। প্রকল্প চলাকালে দেশের নাগরিকের মৃত্যু সম্পর্কে আরেকজন সদস্য বলেন, বিদ্যমান ফৌজদারি আইনেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে অবহেলাজনিত হত্যার কারণে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনে যেহেতু শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, সেহেতু উক্ত আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করছে।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে
প্রধান বিচারক বলেন, বাদীপক্ষ ১২টি সংযুক্তির মাধ্যমে তাদের অভিযোগের প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছে। বৈষম্যমূলক চুক্তি এবং জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে বৈষম্যমূলক চুক্তি করে এই জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বৈষম্যমূলক ও জনস্বার্থবিরোধী এই প্রকল্প ও চুক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালত নির্দেশ প্রদান করছেন।
রায়ে প্রধান বিচারক পান্থকুঞ্জ সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ও গাছরক্ষা আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রকল্পের কাজ স্থগিত ঘোষণা করে রায় দেন।
গণশুনানিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা এবং একজন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটে এই রায়
এই রায় কেবল একটি পার্কের গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়, বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ সুরক্ষার বৃহত্তর আন্দোলনের একটি অংশ। নগরের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত উদ্যানগুলো যখন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ধ্বংস হয়ে যায়, তখন তা কেবল সবুজ কমে যাওয়া নয়, বরং শহরের উষ্ণতা বৃদ্ধি, বায়ু দূষণ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ হয়। এই রায় জনস্বার্থে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদের জয়। এটি প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর এবং পরিবেশ সচেতনতা বড় প্রকল্পগুলোর স্বেচ্ছাচারিতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষায় নতুন দিগন্ত
আপনার মতামত:
পান্থকুঞ্জের এই গণআদালতের রায়কে আপনি কীভাবে দেখছেন? এটি কি পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ? এই ধরনের জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্পের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আর কী ধরনের ভূমিকা রাখা উচিত বলে আপনি মনে করেন? নিচে মন্তব্য করে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।