27 C
Bangladesh
সোমবার, জুন ২, ২০২৫
spot_img

হাতি কেন লোকালয়ে? নেপথ্যের কারণ জানলে চমকে যাবেন!

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী বাতকুচি টিলার ঢালে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আবারও আমাদের সামনে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের প্রশ্নটি নিয়ে এসেছে। গত শুক্রবার রাতে ৩৫ থেকে ৪০টি বন্য হাতির পাল ৩০টি বসতবাড়িতে হানা দেয়। এ সময় হাতির দল ঘর ভেঙে ধান-চাল খেয়ে সাবাড় করেছে এবং আসবাবপত্র তছনছ করেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে একই এলাকায় হাতির আক্রমণে সুরতন নেছা (৬০) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া পাশের কায়াটাবাড়ি এলাকায় বন বিভাগের বিট কার্যালয়সহ ছয়টি ঘর ভেঙে তছনছ করে হাতির দল। হাতি কেন লোকালয়ে

হাতির দলের উপদ্রব: এক নতুন বাস্তবতা

বন বিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার দাওধারা-কাটাবাড়ি পাহাড়ের টিলায় গত এক সপ্তাহ ধরে ৩৫ থেকে ৪০টি বন্য হাতি দল বেঁধে অবস্থান করছে। গত কয়েক দিনে হাতির আক্রমণে বাতকুচি বিট কার্যালয়, দাওধারা-কাটাবাড়ি ছয়টি বসতঘরে হামলার পাশাপাশি গত বুধবার রাতে মধুটিলা ইকো পার্কের ক্যানটিনে হামলার ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে বৃষ্টির মধ্যে হাতির পালটি বাতকুচি নামাপাড়া এলাকায় সুরতন নেছার ঘরে হানা দেয়। এ সময় হাতির আক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর থেকে হাতির পালটি বাতকুচি পাহাড়ের টিলায় অবস্থান করছে। হাতি কেন লোকালয়ে

গত সন্ধ্যার পর থেকে হাতির পালটি জঙ্গল ছেড়ে বাতকুচি এলাকায় নেমে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু বন বিভাগের কর্মকর্তা, এলাকাবাসী ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্যরা রাত ১১টা পর্যন্ত মশাল জ্বালিয়ে হইহুল্লোড় করে হাতির দলকে বাতকুচি জঙ্গলের দিকে ফিরিয়ে দেয়। পরে হাতির দলটি বাতকুচি নামাপাড়া এলাকায় হানা দেয়। এ সময় হাতির আক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকজন নিরাপদ দূরত্বে সরে পড়েন। সেই সুযোগে ৩০টি বসতঘর ভেঙে ঘরে থাকা ধান-চাল খেয়ে আসবাব তছনছ করে দেয়। শেষ রাতে দলটি বাতকুচি জঙ্গলে ফিরে যায়।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক হোসেন আলী (৪৫) জানান, ২৩টি পরিবারের ৩০টির বেশি বসতঘর ও আসবাব ভেঙে তছনছ করেছে বন্য হাতির দল। ঘরে থাকা ধান-চাল খেয়ে সাবাড় করেছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “এখন ধান-চাল দূরের কথা একমুঠো শর্ষেও ঘরে নেই।” হাতির আক্রমণে পরিবারগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

বন বিভাগের মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা দেওয়ান আলী জানান, মশাল জ্বালিয়ে হাতির দলকে বাতকুচি জঙ্গলের দিকে ফেরাতে তাঁরা রাত ১১টা পর্যন্ত চেষ্টা করেন। পরে রাত ১২টার দিকে হাতির দল বাতকুচি নামাপাড়া এলাকায় বসতঘর ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ পেতে আবেদন করতে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, হাতির দলটি এখন বাতকুচি এলাকার জঙ্গলে অবস্থান করছে এবং এলাকাবাসীকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। হাতি কেন লোকালয়ে

কেন এই সংঘাত?

নালিতাবাড়ীতে বন্য হাতির আক্রমণে ৩০ বসতবাড়ি ভাঙচুর, ধান-চাল খেয়ে সাবাড় হওয়ার ঘটনা কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি মানব-বন্যপ্রাণী সংঘাতের এক জটিল চিত্র। এর পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ, যা মূলত জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার দিকেই ইঙ্গিত করে।

প্রথমত, বন উজাড় এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস এর অন্যতম প্রধান কারণ। হাতির প্রাকৃতিক বিচরণক্ষেত্র সঙ্কুচিত হওয়ায় তারা খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। মানুষের বসতি এবং কৃষিজমির বিস্তার হাতির চলাচলের পথে বাধা সৃষ্টি করছে, যার ফলে হাতির দল বাধ্য হয়ে মানুষের কাছাকাছি চলে আসছে।

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিবর্তন আসছে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, ঋতুচক্রের পরিবর্তন হাতির খাদ্যের উৎসকে প্রভাবিত করছে। শুষ্ক মৌসুমে খাবার ও পানির অভাবে হাতি লোকালয়ে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।

তৃতীয়ত, কৃষিকাজের ধরন পরিবর্তনও একটি কারণ। যেখানে আগে মানুষ হাতির উপদ্রব এড়াতে নির্দিষ্ট কিছু ফসল চাষ করত, এখন উচ্চ ফলনশীল ধানের মতো ফসল চাষের প্রবণতা বেড়েছে, যা হাতির জন্য আকর্ষণীয় খাদ্যে পরিণত হয়েছে।

সমাধানের পথ: সহাবস্থানই একমাত্র উপায়

এই সমস্যার সমাধান কেবল ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই সমাধানের দাবি রাখে।

  1. বন সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি: হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল পুনরুদ্ধার এবং নতুন বনভূমি সৃষ্টি করা জরুরি। এতে হাতির খাদ্যের সংস্থান হবে এবং তাদের লোকালয়ে আসার প্রবণতা কমবে।
  2. বাফার জোন তৈরি: বন এবং লোকালয়ের মাঝে একটি বাফার জোন তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে হাতি সহজে প্রবেশ করতে পারবে না।
  3. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় মানুষদের হাতির আচরণ এবং তাদের সাথে সহাবস্থানের উপায় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
  4. বিকল্প জীবিকা: হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বিকল্প জীবিকার সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে তারা কৃষিজমির উপর এককভাবে নির্ভরশীল না হয়।
  5. প্রযুক্তি ব্যবহার: হাতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন জিও-ফেন্সিং বা ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে আগে থেকে সতর্ক করা যায়।

নালিতাবাড়ীর এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য কতটা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই ধরনের সংঘাত ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, হাতিরাও এই বাস্তুতন্ত্রের অংশ, এবং তাদের রক্ষা করা আমাদেরই দায়িত্ব।

আপনার মতামত:

নালিতাবাড়ীর এই ঘটনায় আপনার কী মনে হয়? বন্য হাতির আক্রমণে ৩০ বসতবাড়ি ভাঙচুর, ধান-চাল খেয়ে সাবাড় হওয়ার মতো ঘটনাগুলো এড়াতে আমরা আর কী পদক্ষেপ নিতে পারি? জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষায় আপনার কী কী পরামর্শ আছে? নিচে মন্তব্য করে জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ