27 C
Bangladesh
সোমবার, জুন ২, ২০২৫
spot_img

বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে কি মুছে যাবে দুই দ্বীপ?

সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় অন্তত ১ হাজার ৬০০ মিটার বেড়িবাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে মহেশখালীতে ৯০৫ মিটার এবং কুতুবদিয়ায় ৬৯৬ মিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে। গত কয়েক দিনের লাগাতার ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের ধাক্কায় এসব বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। জোয়ারের তীব্রতা না কমায় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের পাশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের মধ্যে এখন চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এই ঘটনা আবারও আমাদের সামনে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাবের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের মানচিত্র

প্রকৃতির রোষানলে দুই দ্বীপ

মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের পশ্চিমে ষাইটপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বেড়িবাঁধের উপর বসানো অধিকাংশ জিও টিউব সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। সেই স্থান দিয়ে অবাধে ঢুকছে জোয়ারের পানি। একই চিত্র ধলঘাট ইউনিয়নের সরইতলা বেড়িবাঁধেরও। সেখানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে এখন জোয়ার-ভাটা খেলছে। স্থানীয়দের বর্ণনায় উঠে এসেছে এক মর্মান্তিক চিত্র। ষাইটপাড়ার অন্তত এক কিলোমিটার অরক্ষিত বেড়িবাঁধের পাশে প্রায় এক হাজার পরিবার বসবাস করে। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারের তিন দফা বৃষ্টিতে জোয়ারের পানি ঢুকে এসব পরিবারের বাড়িঘর, ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। ১০টি কাঁচা ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। দ্রুত সংস্কার না করা হলে আসন্ন পূর্ণিমার জোয়ারে আরও বিস্তীর্ণ এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ার আশঙ্কায় ভুগছেন তারা। বাংলাদেশের মানচিত্র

এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, এই অরক্ষিত বেড়িবাঁধের কারণে তাদের অন্তত এক হাজার পরিবার প্রকৃতির সঙ্গে এক অসম লড়াই করে কোনোরকমে বেঁচে আছে। প্রতি বর্ষার মৌসুমে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

এদিকে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার পরিস্থিতিও একইরকম উদ্বেগজনক। বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র ও তাবালরচর এলাকায় ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। দ্বীপের আরও বেশ কিছু এলাকায় বেড়িবাঁধ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে, কিন্তু ভবিষ্যৎ কি?

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিম্নচাপের প্রভাবে তিন দফা জোয়ারের পানি ঢুকে অনেক এলাকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে এবং অন্তত ৩০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে এবং দ্রুত বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়েছে।

কুতুবদিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। তবে, আবহাওয়ার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি জোয়ারের পানি কমে যাওয়ায় আপাতত নতুন করে লোকালয়ে প্লাবিত হয়নি। কিন্তু ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, নিম্নচাপের প্রভাবে মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় ১ হাজার ৬০০ মিটার বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মহেশখালীতে ৯০৫ মিটার এবং কুতুবদিয়ায় ৬৯৬ মিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপাতত বর্ষার মৌসুমে জোয়ারের পানি ঠেকাতে কুতুবদিয়ার ভাঙা বেড়িবাঁধে জিও টিউব বসানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অন্তত দুই কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। একইভাবে মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধলঘাট ইউনিয়নের জন্য এক কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে দ্রুত বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন: এক নীরব ঘাতক

এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেগুলোর তীব্রতা বাড়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ক্রমশ অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে টিকে থাকতে পারছে না। হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর তাদের আশ্রয়, জমি এবং জীবিকা হারাচ্ছে। পরিবেশের উপর মানুষের অবিবেচক হস্তক্ষেপের ফলস্বরূপ প্রকৃতি এখন তার নিজস্ব ভারসাম্য হারাচ্ছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এই বেড়িবাঁধ শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার ঢাল নয়, এটি উপকূলীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার রক্ষাকবচ। যখন ঢেউয়ে বিলীন মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার ১ হাজার ৬০০ মিটার বেড়িবাঁধ হয়, তখন শুধু মাটি আর পাথরই বিলীন হয় না, বিলীন হয় হাজারো মানুষের স্বপ্ন, তাদের নিরাপত্তা এবং সুস্থ ভবিষ্যৎ।

করণীয় কি?

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং জরুরি পদক্ষেপ। শুধুমাত্র ত্রান সহায়তা প্রদানই যথেষ্ট নয়। স্থায়ী এবং টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় বনায়ন, প্রাকৃতিক প্রতিবেশ সংরক্ষণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কারণ, এই সমস্যা আমাদের সকলের। যখন আমরা সচেতন হব, তখন আমরা সম্মিলিতভাবে এর সমাধানের জন্য কাজ করতে পারব। আসুন, প্রকৃতির এই নীরব কান্না শুনি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার অঙ্গীকার করি।

আপনার মন্তব্য আমাদের কাছে মূল্যবান: আপনি কি মনে করেন, ঢেউয়ে বিলীন মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার ১ হাজার ৬০০ মিটার বেড়িবাঁধ এর ঘটনা আমাদের সকলের জন্য একটি সতর্কবার্তা? জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষায় আপনার কী কী পরামর্শ রয়েছে? নিচে মন্তব্য করে জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ