26.1 C
Bangladesh
বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫
spot_img

বন্যা ও বেড়িবাঁধের ফাটল, আমাদের ভবিষ্যৎ কতটা সুরক্ষিত?

টানা ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রভাবকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। ফেনী, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সৃষ্ট এই পরিস্থিতি কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং প্রকৃতির প্রতি আমাদের দীর্ঘদিনের অবহেলা এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফল। এই ঘটনাগুলো আমাদের পরিবেশ সচেতনতার গুরুত্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। বন্যা ও বেড়িবাঁধের ফাটল

ফেনীর মুহুরী-সিলোনিয়া: বিপৎসীমার কাছাকাছি পানি, বেড়িবাঁধে ফাটল

ফেনীতে টানা চার দিনের ভারী বর্ষণ এবং ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার (১৩ মিটার) কাছাকাছি ১২.১০ মিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নদীপাড়ের কয়েক হাজার বাসিন্দা বন্যার আতঙ্কে রয়েছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুলগাজী উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ বরইয়ায় মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধ এবং আনন্দপুর ইউনিয়নের খিলপাড়ায় সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের একাংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। এই ফাটলগুলো বেড়িবাঁধসংলগ্ন কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বন্যা ও বেড়িবাঁধের ফাটল

ফুলগাজী বাজারেও পানি উঠতে শুরু করেছে, যা বাজারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বেড়িবাঁধে ফাটলের তথ্য পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে, মেরামত কাজ নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে, যেখানে প্রত্যেকেই দায় অপরের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। এই ধরনের পরিস্থিতি দুর্যোগকালীন সময়ে উদ্ধার ও মেরামতের কাজকে আরও জটিল করে তোলে। বৃষ্টির পরিমাণ কমে না আসা পর্যন্ত বা পানি না কমা পর্যন্ত মেরামতের কাজ সম্ভব নয় বলে জানানো হয়েছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়াবে।

সীতাকুণ্ডে জলাবদ্ধতা: ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি পানির নিচে

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অতি ভারী বর্ষণে পাঁচটি ইউনিয়নের সাতটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি—সবই এখন পানির নিচে। অনেক পরিবার রান্না করতে না পারায় খাবার নিয়ে সংকটে পড়েছে। সীতাকুণ্ড আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় ১৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলেই তাকে অতি ভারী বর্ষণ বলা হয়। বন্যা ও বেড়িবাঁধের ফাটল

বারৈয়ারঢালা, সৈয়দপুর ও মুরাদপুর ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হেক্টর সবজিখেত সম্পূর্ণভাবে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এছাড়া, কুমিরা ও সোনাইছড়ির যেসব এলাকায় বেড়িবাঁধ নেই, সেখানে প্রায় ৬ হেক্টর জমিতে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়েছে, যা কৃষি জমির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করবে। কুমিরা ইউনিয়নের উত্তর মছজিদ্দা গ্রামের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া এলাকায় কোমরসমান পানি দেখা গেছে, যেখানে প্রায় ১০০টি বসতঘর ডুবে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, পাহাড়ি ঢলের কারণে ভোররাতের দিকে ঘরের ভেতর পানি ঢুকে যায় এবং রান্নাঘরের চুলা ডুবে যাওয়ায় তাদের খাবার কিনে খেতে হচ্ছে।

বারৈয়ারঢালা এলাকার একটি কালভার্ট মাসখানেক আগে ভেঙে নতুন করে করার কথা থাকলেও, এখনো কাজ শুরু হয়নি, যার ফলে যাতায়াতে ব্যাপক অসুবিধা তৈরি হয়েছে। এই ঘটনাগুলো আবারও অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা তুলে ধরে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, কুমিরা ও সোনাইছড়ি ইউনিয়নের দুটি এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর করণীয় ঠিক করার কথা বলা হয়েছে।

আখাউড়ার পরিস্থিতি: সীমান্ত গ্রাম প্লাবিত, স্থলবন্দরে শঙ্কা

টানা ভারী বৃষ্টি এবং ভারতের পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের আশপাশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আখাউড়ার কালন্দি খাল, জাজি গাঙ এবং হাওড়া নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের কালিকাপুর, বীরচন্দ্রপুর, আবদুল্লাহপুর, বঙ্গেরচর গ্রামের ফসলি জমি, রাস্তাঘাট ও কিছু বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। উপজেলার কেন্দুয়াই মেলার মাঠ এলাকায় অন্তত ১৫টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১৫ থেকে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে এবং এতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। আখাউড়া স্থলবন্দরের মৎস্য রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জানান, বন্দরে রপ্তানিতে এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব না পড়লেও, পানি বাড়তে থাকলে আখাউড়া-আগরতলা সড়ক তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা দুই দেশের বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। যদিও হাওড়া নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তবে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৪৮ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগের কারণ। গত বছরও একই সময়ে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আখাউড়া উপজেলার ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং আমাদের পরিবেশের সংকট

এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়; এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় চিত্র তুলে ধরছে। অনিয়মিত এবং অতিবৃষ্টির কারণে নদীগুলো ফুলে উঠছে, বেড়িবাঁধে ফাটল ধরছে, এবং পাহাড়ি ঢলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদী দখল, বৃক্ষনিধন এবং পরিবেশ আইন অমান্য করা—এসবই আমাদের এই সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেয়।

এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের একটি সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। শুধুমাত্র দুর্যোগের পর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ত্রাণ বিতরণ যথেষ্ট নয়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে:

  1. টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামত: দুর্বল এবং ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামত ও শক্তিশালী করা।
  2. নদী খনন ও দখলমুক্তকরণ: নদীর গভীরতা বৃদ্ধি এবং অবৈধ দখলমুক্ত করা, যাতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকে।
  3. পরিকল্পিত নগরায়ন: জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মাথায় রেখে নগরায়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণ করা।
  4. বনায়ন ও সবুজায়ন: ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ করা, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায়, যা মাটির ক্ষয় রোধে এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে সহায়ক।
  5. দুর্যোগ প্রস্তুতি ও সচেতনতা: দুর্যোগ পূর্বাভাস ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, যাতে তারা সময় মতো আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারে।
  6. আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়: বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এবং সংস্থার মধ্যে উন্নত সমন্বয় নিশ্চিত করা, যাতে দুর্যোগকালীন সময়ে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে কাজ করা যায়।
শেষ কথা

ভারী বৃষ্টি এবং এর ফলে সৃষ্ট বন্যা ও পাহাড়ধসের ঘটনাগুলো আমাদের জন্য এক নির্মম বাস্তবতা। প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে আমরা উন্নতি করতে পারি না। পরিবেশের সঙ্গে সহাবস্থানই আমাদের একমাত্র পথ। আসুন, আমরা সবাই মিলে জলবায়ু পরিবর্তনের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদের দায়িত্ব পালন করি এবং একটি সুস্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ি।

আপনার মতে, এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমাতে এবং মানুষের জীবন বাঁচাতে আমরা আর কী কী পদক্ষেপ নিতে পারি? আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্ট করে জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ