সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেছেন – “দেশের ১৮ কোটি মানুষেরই পরিবেশ সচেতন হওয়া জরুরি।” এই কথাটি কেবল একটি স্লোগান নয়, বরং আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। আসুন, এই মন্তব্যের গভীরতা এবং এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। পরিবেশ রক্ষায় চাই ১৮ কোটি হাত
কেন পরিবেশ সচেতনতা এত জরুরি?
রিজওয়ানা হাসান অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলেছেন যে, রাস্তা, ফ্লাইওভার বা বিদ্যুৎ জীবনের মূল চাহিদা হতে পারে না। তাঁর এই বক্তব্য আমাদের প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা প্রায়শই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে জীবনের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে দেখি, যেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নই সব। কিন্তু তিনি যথার্থই বলেছেন, যদি বাতাস ও পানি দূষিত হয়, তবে বিদ্যুৎ দিয়ে সবকিছু ঠিক রাখা সম্ভব নয়। ফুসফুসে ক্যানসার হয় এমন বাতাসে বিদ্যুৎ দিয়ে কী হবে? বাতাস পরিশোধনের জন্য পর্যাপ্ত গাছ না থাকলে রাস্তা দিয়ে কী হবে? পরিবেশ রক্ষায় চাই ১৮ কোটি হাত
এই প্রশ্নগুলো আমাদের পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ককে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। দূষিত বাতাস আমাদের শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করে, পানি দূষণ ঘটায় নানা ধরনের রোগ। এই মৌলিক সমস্যাগুলো যদি সমাধান না হয়, তাহলে আধুনিক সুবিধাগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ থাকলেও যদি হাসপাতালের বেডে দূষিত বাতাস সেবন করতে হয়, তাহলে সেই বিদ্যুতের কি কোনো মূল্য থাকে? উন্নয়নের এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ধীরে ধীরে একটি অস্বাস্থ্যকর এবং বিপদাপন্ন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই, সুস্থ জীবনযাপনের জন্য পরিবেশ সচেতনতা অপরিহার্য।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
১লা জুন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিবেশ অধিদপ্তর মিলনায়তনে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে ‘পরিবেশবিষয়ক সংস্কার ভাবনা: বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনাসভায় রিজওয়ানা হাসান এই কথাগুলো বলেন। এই আলোচনার বিষয়বস্তু নিজেই বলে দেয় যে আমরা এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের কোনো ধারণা নয়, এটি আমাদের বর্তমান বাস্তব। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় – এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল। এই পরিবর্তনগুলো আমাদের কৃষি, অর্থনীতি এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। পরিবেশ রক্ষায় চাই ১৮ কোটি হাত
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। শুধুমাত্র সরকার বা নির্দিষ্ট কিছু সংস্থার পক্ষে এই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এখানে ১৮ কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যক। প্রত্যেক নাগরিক যদি নিজের জায়গা থেকে সচেতন হয় এবং পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখে, তবেই আমরা একটি টেকসই ভবিষ্যৎ আশা করতে পারি।
কীভাবে আমরা পরিবেশ সচেতন হতে পারি?
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যা আমাদের পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে:
- শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবেশ অন্তর্ভুক্ত করা: ছোটবেলা থেকেই যদি শিশুদের পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে তারা বড় হয়ে আরও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। পাঠ্যপুস্তকে পরিবেশ বিজ্ঞানকে আরও গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা এবং ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা জরুরি।
- প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে পরিবেশ ভাবনা সংযুক্ত করা: কেবল পরিবেশ মন্ত্রণালয় নয়, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। যেমন, সড়ক নির্মাণে গাছ কাটার পরিবর্তে বিকল্প বৃক্ষরোপণের ব্যবস্থা করা, শিল্পায়নে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, নগর পরিকল্পনায় সবুজায়নকে গুরুত্ব দেওয়া – এই বিষয়গুলো প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের অংশ হওয়া উচিত।
- পরিবেশ শিক্ষা ও সচেতনতাকে গুরুত্ব দেওয়া: গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্থানীয় পর্যায়ের কর্মসূচির মাধ্যমে পরিবেশ সম্পর্কিত তথ্য ও জ্ঞান সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। সেমিনার, কর্মশালা এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে মানুষের মধ্যে পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
- উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে সামঞ্জস্য: রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, “আমরা পরিবেশ রক্ষা না করে উন্নয়ন করতে পারি না। পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই উন্নয়ন করতে হবে।” এটি একটি মৌলিক সত্য। অপরিকল্পিত এবং পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদে আমাদের কোনো সুবিধা দেবে না। বরং এটি পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ায়। টেকসই উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করা প্রয়োজন, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশ সুরক্ষা হাতে হাত রেখে চলে।
সভায় উপস্থিত অন্যান্য বক্তারাও
এই আলোচনায় মূল্যবান মতামত দিয়েছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম, বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. খন্দকার রাশেদুল হক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু, ওয়েস্ট কনসার্নের নির্বাহী পরিচালক আবু হাসনাত মো. মাকসুদ সিনহা, বাপা সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার এবং বেলার ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর বারিস চৌধুরী – সকলেই পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিয়েছেন। মূল প্রবন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মাসুদ ইকবাল মো. শামীম বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
শেষ কথা: আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব
১৮ কোটি মানুষের এই দেশে, পরিবেশ সচেতনতা কেবল একটি নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে চাইলে, আমাদের এখনই কাজ শুরু করতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু অবদান রাখতে পারি। হতে পারে সেটি বিদ্যুতের অপচয় কমানো, পানির অপচয় রোধ করা, যত্রতত্র ময়লা না ফেলা, অথবা সম্ভব হলে একটি গাছ লাগানো। ছোট ছোট এই পদক্ষেপগুলো সম্মিলিতভাবে একটি বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এই ১৮ কোটি মানুষের সচেতনতার ঢেউ তৈরি করি, যা আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে আমাদের বাঁচাবে। আপনার মতে, পরিবেশ রক্ষায় একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আপনি আর কী কী করতে পারেন? মন্তব্য করে জানান এবং এই আলোচনায় অংশ নিন।