গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। পাহাড়ি ঢলে মাইনী নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দীঘিনালার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, যা রাঙামাটির লংগদু এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের গ্রামীণ সড়ক ও ফসলের খেত তলিয়ে দিয়েছে। লংগদু-দীঘিনালা সড়কে সরাসরি যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। এই ঘটনা আবারও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের প্রতি আমাদের অবহেলার মারাত্মক পরিণতিকে সামনে নিয়ে এসেছে। খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ঢল
খাগড়াছড়ির বর্তমান পরিস্থিতি: জলমগ্ন জনজীবন
মাইনী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের সোবাহানপুর, চিটাগাংগ্গ্যেপাড়া এবং মেরুং বাজারের একাংশ পানিতে ডুবে গেছে। দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেডকোয়ার্টার, আটরকছড়াসহ কয়েকটি স্থান ডুবে যাওয়ায় সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে, যা স্থানীয়দের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন ও যানবাহন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সোমবার সন্ধ্যা থেকেই দীঘিনালার হেডকোয়ার্টার এলাকায় লংগদু সড়কের প্রায় কয়েক শ মিটার পানিতে ডুবে যায়। রাতেই সড়কের ওপর বেশ কিছু যানবাহন আটকা পড়ে। উপায়ন্তর না দেখে ওই এলাকার যাত্রীরা হেঁটে ডুবে যাওয়া সড়ক পার হয়ে অপর পাশ থেকে আবার যানবাহন নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছান। আজ দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পণ্যবাহী একটি ট্রাক পানিতে বিকল হয়ে পড়ে আছে এবং লোকজন কোমরসমান পানি ডিঙিয়ে সড়ক পার হচ্ছেন। খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ঢল
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অমিত কুমার সাহা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে এবং পানি কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গতকাল দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে শতাধিক লোকজন আশ্রয় নিলেও আজ সকালে একটা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সবাই চলে গেছে। বর্তমানে ছোট মেরুং বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ৪৮ জন অবস্থান করছেন, যাদের খাবার এবং পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পাহাড়ি ঢল: প্রকৃতির রোষ নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব?
খাগড়াছড়িতে এই পাহাড়ি ঢল বা বন্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পার্বত্য অঞ্চলে ভারী বর্ষণজনিত ঢল এবং ভূমিধস এখন প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনাগুলো সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের উপর মানুষের নেতিবাচক হস্তক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত।
- অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ধরণ: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলে যাচ্ছে। স্বল্প সময়ে অস্বাভাবিক ও তীব্র বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যা মাটিকে পানি ধারণের সুযোগ না দিয়েই পাহাড় থেকে দ্রুত নিচে নামিয়ে আনছে। এই অতিরিক্ত পানিই ঢল সৃষ্টি করছে এবং নদীর পানি বাড়িয়ে দিচ্ছে। খাগড়াছড়ির মতো পাহাড়ি অঞ্চলে এই প্রবণতা আরও বিপজ্জনক, কারণ এখানকার মাটি ও ভূতাত্ত্বিক গঠন দ্রুত ভূমিধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ঢল
- বন উজাড় ও পাহাড় কাটা: পার্বত্য অঞ্চলগুলো বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বন ও জীববৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে বন উজাড়, কৃষিকাজ সম্প্রসারণ, বসতি স্থাপন এবং অবৈধভাবে পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের মাটির বাঁধন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা না থাকলে মাটির ক্ষয় রোধ হয় না এবং বৃষ্টির পানি সহজে নিচে নেমে আসে, যা ঢলের তীব্রতা বাড়ায়।
- নদী ও ছড়ার ভরাট: নির্বিচারে বর্জ্য ফেলা এবং পলি জমার কারণে নদী ও ছড়াগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে, সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি উপচে পড়ে এবং আশেপাশের এলাকা প্লাবিত হয়। এটি নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং ঢলের পানি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে।
- আদিবাসী জীবনযাত্রার উপর প্রভাব: পাহাড়ি ঢল এবং বন্যার কারণে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। তাদের কৃষি জমি, ঘরবাড়ি এবং যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের জীবন-জীবিকা এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানও এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে আসছেন যে, যদি আমরা পরিবেশের প্রতি যত্নশীল না হই এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তাহলে ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্যোগ আরও বাড়বে এবং এর তীব্রতাও বৃদ্ধি পাবে।
মানবিক সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের গুরুত্ব
খাগড়াছড়ির বর্তমান পরিস্থিতি একটি মানবিক সংকটের সৃষ্টি করেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজনের আশ্রয়, তাদের জন্য খাবার ও পানির ব্যবস্থা করা জরুরি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত কুমার সাহা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা প্রশংসনীয়। তবে, এটি কেবল একটি তাৎক্ষণিক সমাধান।
দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য আমাদের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করতে হবে:
- পাহাড় ও বনের সুরক্ষা: পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং বনায়ন কর্মসূচি জোরদার করা অত্যাবশ্যক। পার্বত্য অঞ্চলে গাছপালা রোপণ ও বনভূমি সংরক্ষণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
- নদী ও ছড়ার ব্যবস্থাপনা: নদী ও ছড়াগুলোর নাব্যতা বজায় রাখতে নিয়মিত খনন করা এবং এর গতিপথ পরিষ্কার রাখা জরুরি। বর্জ্য ফেলা রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় জনগণের মধ্যে দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি এবং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা এবং দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
- জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন: জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য অভিযোজনমূলক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে দুর্যোগ-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ এবং কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত।
- গবেষণা ও পূর্বাভাস: পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের ঝুঁকি মূল্যায়নে আরও গবেষণা এবং উন্নত পূর্বাভাস ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।
খাগড়াছড়ির এই পাহাড়ি ঢল আমাদের জন্য একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যৎ হুমকি নয়, বরং এটি আমাদের বর্তমানকে প্রভাবিত করছে। যদি আমরা পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল না হই এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তাহলে এই ধরনের দুর্যোগ আরও বাড়বে এবং এর পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে।
আসুন, আমরা সবাই পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হই এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখি। এই বিষয়ে আপনার মূল্যবান মতামত নিচে মন্তব্য করে জানান!