শেরপুর আবারও পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় ভুগছে। উজান থেকে নেমে আসা জলের তোড়ে জেলার চারটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। এর মধ্যে চেল্লাখালী নদীর পানি ইতিমধ্যেই বিপৎসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে বন্যার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস নয়, বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের উপর মানুষের অবিরাম হস্তক্ষেপের এক মারাত্মক পরিণতিকে আমাদের সামনে তুলে ধরছে। শেরপুরে আবারও পাহাড়ি ঢল
শেরপুরের নদ-নদীর বর্তমান চিত্র: বিপৎসীমার কাছাকাছি জলস্তর
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, আজ সোমবার (জুন ৩, ২০২৫) দুপুর ১২টা পর্যন্ত চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুধু চেল্লাখালী নয়, ভোগাই ও শেরপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানিও বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এছাড়াও ঝিনাইগাতীতে মহারশি নদ ও সোমেশ্বরী নদীর পানি গতকাল রোববার রাত থেকে আবারও বাড়তে শুরু করেছে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলাতেও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় সেখান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি শেরপুরের নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। একটু থেমেই আবার পানি বাড়তে থাকায় স্থানীয়দের উদ্বেগ বাড়ছে। শেরপুরে আবারও পাহাড়ি ঢল
চেল্লাখালী নদীর পাড়ের কচুবাড়ি গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী বাসিন্দা আজম আলী বলেন, “সকালবেলায় প্রচণ্ড বৃষ্টি অইছে। মেঘালয়ে বৃষ্টি অইলে আমগর নদীতে ঢল নামে। সকাল থাইকা নদী দিয়া ঢলের পানি বাড়তাছে। এইভাবে পানি বাড়তে থাকলে বন্যার আশঙ্কা আছে।”
নালিতাবাড়ী উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নূরে আলমও একই শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “একটু থেমেই গতকাল রোববার রাত থেকে আবার চেল্লাখালী নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। ঢলের পানি আর বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে কিছুটা বিপত্তিই হবে।”
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢলে মহারশি ও সোমেশ্বরীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, যদি এলাকায় আর বৃষ্টি না হয়, তাহলে নদীর পানি দ্রুত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাউবোর শেরপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আখিনুজ্জামানও একই কথা বলেন। তিনি জানান, জেলার চারটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি রয়েছে, এবং চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তার মতে, আজ ও আগামীকাল বৃষ্টিপাত না হলে নদীর পানি কমে যাবে। শেরপুরে আবারও পাহাড়ি ঢল
জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম প্রভাব: কেন এই বারবার ঢল?
শেরপুরের নদ-নদীগুলোতে বারবার পাহাড়ি ঢলের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের উপর মানুষের ক্রমাগত নেতিবাচক প্রভাবের একটি স্পষ্ট নিদর্শন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফল, পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করছে। এর ফলে, আমরা এখন এমন সব চরম আবহাওয়ার ঘটনা দেখতে পাচ্ছি, যা অতীতে বিরল ছিল।
এই ধরনের পাহাড়ি ঢল বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান, যার সাথে জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি জড়িত:
- অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে অল্প বৃষ্টি না হয়ে হঠাৎ করে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যা উজান থেকে বিপুল পরিমাণ পানি নদীতে নামিয়ে আনছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অবিরাম বৃষ্টিপাত এর একটি প্রমাণ, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে শেরপুরের নদ-নদীগুলোতে।
- হিমালয় ও সংলগ্ন অঞ্চলের বরফ গলা: বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে হিমালয় ও এর সংলগ্ন অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলছে, যা নদ-নদীগুলোতে পানির প্রবাহ বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে।
- বন উজাড় ও পাহাড় কাটা: উজানের অঞ্চলে (বিশেষ করে সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকা) অপরিকল্পিতভাবে বন উজাড় এবং পাহাড় কাটার ফলে মাটির বাঁধন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা না থাকায় বৃষ্টি হলে মাটি সহজে পানি ধরে রাখতে পারে না এবং দ্রুত ধসে পড়ে, যা ঢলের গতি ও পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এটি শুধুমাত্র পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকিই বাড়ায় না, বরং ভূমিধসের মতো দুর্যোগের সম্ভাবনাও সৃষ্টি করে।
- নদী ভরাট ও গতিপথ পরিবর্তন: পলি জমে নদ-নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি উপচে পড়ে এবং বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়।
শেরপুরের ঘটনা প্রমাণ করে যে, প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলছে না, বরং মানুষের কার্যকলাপের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, শিল্পায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং গাছপালা ধ্বংসের কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে, যা পৃথিবীকে উষ্ণ করে তুলছে। এই উষ্ণতা শুধু সমুদ্রের তাপমাত্রাই বাড়াচ্ছে না, বরং বৃষ্টিপাতের ধরন, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা এবং ঢলের ঘটনাকেও প্রভাবিত করছে।
প্রস্তুতির অভাব ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
আফসোসের বিষয় হলো, এই ধরনের বারবার বন্যা এবং পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি দেখা যায়। স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্কের পাশাপাশি অসহায়ত্বও কাজ করছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড পূর্বাভাস দিচ্ছে যে, বৃষ্টি না হলে পানি কমে যেতে পারে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী সবসময় নিশ্চিত নয়। যেকোনো সময় হঠাৎ ভারী বৃষ্টি পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু তাৎক্ষণিক ত্রাণ বা উদ্ধার কাজ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের করণীয়: সচেতনতা ও পদক্ষেপ
শেরপুরের এই পরিস্থিতি আমাদের সকলের জন্য একটি সতর্কবার্তা। পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কেবল বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক বাস্তবতা।
করণীয়:
- সীমান্তবর্তী এলাকায় বনায়ন: উজানের পাহাড়ি অঞ্চলে এবং নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। গাছপালা মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে, যা ঢলের তীব্রতা কমাতে পারে।
- নদী খনন ও নাব্যতা রক্ষা: নদ-নদীগুলোকে নিয়মিত খনন করে তাদের নাব্যতা বজায় রাখতে হবে, যাতে অতিরিক্ত পানি সহজে প্রবাহিত হতে পারে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় জনগণের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বন্যা বা ঢলের পূর্বাভাস পেলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
- পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন: উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এর মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন অপরিহার্য।
শেরপুরের নদ-নদীগুলোতে পাহাড়ি ঢলের এই নতুন বৃদ্ধি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা এক পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার যুগে বাস করছি। এই পরিবর্তনকে উপেক্ষা করা মানে নিজেদেরই বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া। আসুন, আমরা সবাই পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হই এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখি।
আপনার কি মনে হয়, এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের আর কী কী করা উচিত? নিচে মন্তব্য করে আপনার মতামত জানান!