26.7 C
Bangladesh
শুক্রবার, জুন ৬, ২০২৫
spot_img

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াল ভূমিধস: নেপথ্যে জলবায়ু সংকট?

গত দুদিনের অবিরাম বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ৫৩টি স্থানে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, যা ১ হাজার ৪০০টিরও বেশি রোহিঙ্গা ঘরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাটির দেয়াল ধসে একজন রোহিঙ্গার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে এবং বজ্রপাতে আহত হয়েছেন আরও ১১ জন। এই ঘটনা শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্ভোগই বাড়িয়ে দেয়নি, বরং জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের প্রতি আমাদের অবহেলার এক নির্মম পরিণতিকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। নেপথ্যে জলবায়ু সংকট

ধ্বংসের চিত্র: এক দিনে ৫৩টি ভূমিধস

সোমবার বিকেলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনএইচসিআর কক্সবাজার শাখা থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইউএনএইচসিআর-এর অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিনিধি জুলিয়েট মুরেকেইসনি বলেছেন, “মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকায় (আশ্রয়শিবির) বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর ঝোড়ো হাওয়া বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি ঘরগুলোকে আরও দুর্বল করে তুলছে।”

তিনি আরও বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরে স্বেচ্ছাসেবকেরা সহায়তা করছেন। কিন্তু আশ্রয়ের জন্য আমাদের আরও জায়গা দরকার। বর্ষার আগেই শরণার্থীশিবিরে আশ্রয়ের জায়গা কমে গিয়েছিল। বিশেষ করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার হয়ে গত কয়েক মাসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকেই আগে পালিয়ে আসা আত্মীয়স্বজনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। যাঁরা নিজেরাই নিজেদের ঘরকে শুকনা রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।” নেপথ্যে জলবায়ু সংকট

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের সড়ক পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইউএনএইচসিআর এর সৌজন্যে তোলা ছবিতে এই ভয়াবহ দৃশ্য ফুটে উঠেছে।

একটি নিরন্তর ঝুঁকি এবং অর্থের অভাব

কক্সবাজারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং আশপাশের বাংলাদেশি জনগণ এমন একটি এলাকায় বাস করছেন, যেখানে বন্যা, ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি সব সময় থাকে। তিনি আরও বলেন, “এই দুর্যোগের প্রস্তুতি নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ বছর অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।”

মানবিক সহায়তাকারী সংস্থাগুলো ২০২৫ সালে প্রায় ১৪ দশমিক ৮ লাখ মানুষকে সহায়তা করতে ৯৩ দশমিক ৪ কোটি মার্কিন ডলার তহবিল চেয়েছে। যার মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং আশপাশের বাংলাদেশি জনগণ অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে গোয়েন লুইস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “বছরের মাঝপথে পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও এখনো ২০ শতাংশের কম অর্থায়ন এসেছে।” তিনি জরুরিভাবে দাতাদের উদারভাবে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করব। কিন্তু এই কঠিন সময়ে আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবহেলা করতে পারি না। এই দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য আমরা জরুরিভাবে দাতাদের উদাত্ত আহ্বান জানাই, তারা যেন উদারভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।”

জলবায়ু পরিবর্তন: একটি বৈশ্বিক সংকট, স্থানীয় পরিণতি

কক্সবাজারের ভূমিধসের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বৃহত্তর প্যাটার্নের একটি অংশ, যা বিশ্বজুড়ে আরও ঘন ঘন এবং তীব্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ, বিশেষ করে এর উপকূলীয় অঞ্চল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং ভূমিধসের মতো ঘটনাগুলো এই ঝুঁকির স্পষ্ট ইঙ্গিত। নেপথ্যে জলবায়ু সংকট

রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত, যা ভূমিধসের জন্য এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন এবং গাছপালা কেটে ফেলার কারণে মাটির বাঁধন দুর্বল হয়ে গেছে, যা ভূমিধসের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। যখন ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তখন মাটি তার ধারণক্ষমতা হারায় এবং সহজেই ধসে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ধরনের অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত এখন একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন যে, বন উজাড় এবং পাহাড় কাটা ভূমিধসের প্রধান কারণ। কক্সবাজারের এই ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষের আশ্রয় দিতে গিয়ে অনেক পাহাড় কাটা হয়েছে এবং প্রাকৃতিক গাছপালা ধ্বংস করা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র ভূমিধসের ঝুঁকিই বাড়ায়নি, বরং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের উপরও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিকতার আহ্বান

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এমনিতেই চরম দুর্দশার মধ্যে জীবনযাপন করছেন। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন। তাদের জন্য নির্মিত আশ্রয়শিবিরগুলো অস্থায়ী এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট মজবুত নয়। এই ভূমিধসের ঘটনা তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। যারা সামান্য আশ্রয় পেয়েছিলেন, তারাও এখন আশ্রয়হীন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গোয়েন লুইসের জরুরি তহবিল সংগ্রহের আবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই অর্থ কেবল ঘর মেরামত বা নতুন আশ্রয় তৈরির জন্য নয়, বরং এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যও অপরিহার্য। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা না গেলে এই মানবিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগগুলোর প্রস্তুতিতে অর্থের অভাব একটি বৈশ্বিক সমস্যা। উন্নয়নশীল দেশগুলো, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। এটি ধনী দেশগুলোর জন্য একটি নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের বোঝা দরিদ্র দেশগুলো বহন করতে পারে না।

ভবিষ্যতের পথ: প্রতিরোধ, প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

কক্সবাজারের এই ভূমিধসের ঘটনা থেকে আমাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিতে হবে:

  1. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: ভবিষ্যতে ভূমিধসের ঝুঁকি কমাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে পাহাড় কাটা বন্ধ করা, বনায়ন কর্মসূচি জোরদার করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি স্থাপন নিরুৎসাহিত করা জরুরি। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতেও পরিবেশবান্ধব এবং দুর্যোগ-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে জোর দিতে হবে।
  2. দুর্যোগ প্রস্তুতি: প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া অত্যাবশ্যক। দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম মজুদ রাখা এবং স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। অর্থের অভাবে এই প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থাগুলো যেন ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
  3. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এর মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় অর্থায়ন বৃদ্ধি করা জরুরি।
  4. মানবতার প্রতি সংবেদনশীলতা: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আমাদের মানবিক সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে হবে। তাদের দুর্দশা লাঘবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায় থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে ভূমিধসের ঘটনাটি কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকটের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পরিবেশ এবং জলবায়ুকে অবহেলা করার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নিই, তাহলে ভবিষ্যতে এমন আরও অনেক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।

আসুন, আমরা সবাই পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হই এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখি। আপনার সামান্য চেষ্টাও এই বিশাল সংকটে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই বিষয়ে আপনার কী মনে হয়? নিচে মন্তব্য করে জানান!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ