26.5 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০২৫
spot_img

পরিবেশ রক্ষায় পুলিশ কেন ‘কাগুজে বাঘ’?

নদী দখল, পাহাড় কাটা, বন উজাড়, কিংবা শিল্পবর্জ্যে পরিবেশ দূষণ—এই দৃশ্যগুলো আমাদের দেশে খুবই পরিচিত। যখনই আমরা এমন কোনো ঘটনা দেখি বা শুনি, আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, দেশে কি কোনো আইন নেই? যারা এই অপরাধগুলো করছে, তাদের থামানোর কি কেউ নেই? কাগুজে বাঘ

উত্তরটা হলো, আইন আছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার জন্য কাগজে-কলমে বেশ শক্তিশালী আইনকানুনই রয়েছে। কিন্তু আসল প্রশ্নটি হলো সেই আইনগুলোর প্রয়োগ নিয়ে। আইন প্রয়োগের দায়িত্বে থাকা সংস্থা, বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা এই ক্ষেত্রে ঠিক কতটা? গভীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানেই লুকিয়ে আছে এক বিশাল সমন্বয়হীনতা ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, যা পরিবেশ অপরাধীদের জন্য এক ধরনের সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে।

কাগজে-কলমে আমাদের যত আইন

পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের একটি আইনি কাঠামো রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  1. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫: এটি আমাদের প্রধান পরিবেশ আইন, যা দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (EIA) এবং শিল্পকারখানার ছাড়পত্র দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে।
  2. বন আইন, ১৯২৭: প্রায় এক শতাব্দীর পুরনো এই আইনটি বনভূমি সংরক্ষণ, অবৈধভাবে গাছ কাটা এবং বনজ সম্পদ পাচার রোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
  3. ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩: বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস, অবৈধ ইটভাটা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইনটি তৈরি করা হয়েছে।
  4. বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩: নদী, খাল, বিল ও অন্যান্য জলাশয়কে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা এই আইনের মূল উদ্দেশ্য।
  5. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১: কঠিন, চিকিৎসা ও বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধের জন্য এই বিধিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছে।

এই আইনগুলো নিঃসন্দেহে ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মাঠ পর্যায়ে এগুলো বাস্তবায়ন করবে কে এবং কীভাবে?

আইনের গোলকধাঁধাঁয় পুলিশের ভূমিকা: সহায়ক নাকি ক্ষমতাহীন?

পরিবেশগত অপরাধ যখন ঘটে, তখন সাধারণ মানুষ প্রতিকারের জন্য প্রথমেই স্থানীয় থানা বা পুলিশের দ্বারস্থ হতে চায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আমাদের বেশিরভাগ পরিবেশ আইনে পুলিশকে সরাসরি কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তাদের ভূমিকা মূলত ‘সহায়ক’ এবং তা-ও অন্য কোনো সংস্থার অনুরোধের ওপর নির্ভরশীল। কাগুজে বাঘ

  1. পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সীমাবদ্ধতা: এই আইনের মূল প্রয়োগকারী সংস্থা হলো পরিবেশ অধিদপ্তর। পুলিশ বা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজে থেকে এই আইনে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তারা কেবল পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা অনুরোধ করলে সহায়তা প্রদান করতে বাধ্য। সহজ কথায়, আপনার বাড়ির পাশে কোনো কারখানা দিনরাত বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে নদী দূষিত করলেও, পুলিশ সরাসরি সেই কারখানার বিরুদ্ধে এই আইনে ব্যবস্থা নিতে পারে না, যদি না পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে তাদের অনুরোধ করা হয়। এই প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে অপরাধী পার পেয়ে যায়।
  2. বন আইনে সরাসরি ক্ষমতা: তুলনামূলকভাবে বন আইন, ১৯২৭ এ পুলিশকে বেশ কিছু সরাসরি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই আইনের অধীনে পুলিশ কর্মকর্তারা পরোয়ানা ছাড়াই বন অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারেন এবং বনজ সম্পদ জব্দ করতে পারেন। এটি একটি ইতিবাচক উদাহরণ, যা প্রমাণ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরাসরি ক্ষমতা দিলে তা বন রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
  3. অন্যান্য আইনে অনুপস্থিতি: সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, অপেক্ষাকৃত নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রায় অদৃশ্য। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন এবং বাংলাদেশ পানি আইন বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসক এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সদস্যদের নিয়ে নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু যে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর নিয়ে পানি আইনের নির্বাহী কমিটি গঠিত, সেখানে আইন প্রয়োগের সাথে সরাসরি জড়িত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের কোনো প্রতিনিধিই নেই! একইভাবে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও পুলিশের কোনো ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়নি।

এই পরিস্থিতি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট: পরিবেশ রক্ষার মতো একটি গুরুতর বিষয়কে একটি বিশেষায়িত দপ্তরের (পরিবেশ অধিদপ্তর) একক দায়িত্ব হিসেবে দেখা হচ্ছে, এটিকে সাধারণ আইনশৃঙ্খলার বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। কাগুজে বাঘ

ক্ষমতার এই ব্যবধানের ফল কী?

আইন ও প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে এই ক্ষমতার ব্যবধানের কারণে মাঠ পর্যায়ে মারাত্মক কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

১. সময়ক্ষেপণ: পরিবেশগত অপরাধ, যেমন রাতের আঁধারে নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা বা পাহাড় কাটা, খুব দ্রুত ঘটে। পুলিশ খবর পাওয়ার পরও যদি পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, ততক্ষণে অপরাধ সম্পন্ন হয়ে যায় এবং প্রমাণ লোপাট হয়ে যায়।

২. দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থা: অপরাধীরা যখন জানে যে, পরিবেশ দূষণ বা দখলের জন্য স্থানীয় পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবে না, তখন তারা নির্ভয়ে অপরাধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত হয়।

৩. সমন্বয়হীনতার সংকট: বর্তমান ব্যবস্থাটি বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে নিখুঁত সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল, যা আমাদের আমলাতান্ত্রিক বাস্তবতায় প্রায়শই ধীর এবং জটিল।

  1. পরিবেশ অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা: পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবল এবং অবকাঠামো সারা দেশে বিস্তৃত পুলিশ বাহিনীর তুলনায় খুবই সীমিত। তাদের পক্ষে দেশের প্রতিটি প্রান্তে ঘটে যাওয়া পরিবেশগত অপরাধের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া শারীরিকভাবেই অসম্ভব।

সমাধানের পথে: সমন্বয় ও ক্ষমতায়ন

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত এবং সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন। শুধু নতুন আইন তৈরি করলেই হবে না, বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

  1. সরাসরি ক্ষমতায়ন: প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো, পরিবেশ সম্পর্কিত আইনগুলো সংশোধন করে পুলিশকে সরাসরি মামলা গ্রহণ, তদন্ত এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা প্রদান করা। বন আইনের মতো করেই অন্যান্য পরিবেশ আইনেও পুলিশকে সক্রিয় ভূমিকা পালনের সুযোগ দিতে হবে।
  2. বিশেষায়িত ইউনিট গঠন: পুলিশ বাহিনীতে ‘পরিবেশ সুরক্ষা ইউনিট’ বা ‘এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইম সেল’ গঠন করা যেতে পারে, যারা পরিবেশ আইন বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করবে।
  3. জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা: এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যেখানে সাধারণ মানুষ যেকোনো পরিবেশগত অপরাধের বিষয়ে সরাসরি স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পারে এবং পুলিশ সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করতে বাধ্য থাকবে।
  4. সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ: পরিবেশ আইন, পরিবেশগত ফরেনসিক এবং দূষণের মাত্রা নিরূপণের মতো প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোতে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরের বাজেট ও জনবলও বাড়াতে হবে।

শেষ কথা

পরিবেশ রক্ষা কেবল একটি দপ্তরের কাজ নয়, এটি একটি সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলার বিষয়। একজন চোর বা ডাকাত সমাজের যেমন ক্ষতি করে, একজন পরিবেশ অপরাধী তার চেয়েও বহুগুণ বেশি ক্ষতি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে। আমাদের বিশাল পুলিশ বাহিনীকে এই লড়াইয়ে নিষ্ক্রিয় ‘সহায়ক’ হিসেবে বসিয়ে না রেখে, তাদের জ্ঞান, শক্তি এবং দেশব্যাপী নেটওয়ার্ককে কাজে লাগাতে হবে। পরিবেশ অপরাধকে সাধারণ অপরাধের মতোই গুরুত্ব দিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরাসরি ক্ষমতা প্রদান এখন সময়ের দাবি।

এই বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশগত অপরাধকে আর ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই পোস্টটি শেয়ার করে আলোচনাটি ছড়িয়ে দিন এবং পরিবেশ রক্ষায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সরাসরি ক্ষমতা প্রদানের দাবিতে সোচ্চার হোন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ